সরকারি সাইকেল জোড়ায় বিতর্কিত শ্রমিক, প্রশ্ন

ইস্পাতের ‘রিম’-এর ফাঁক দিয়ে ‘স্পোক’ বসানো শেষ। অভ্যস্ত দ্রুততায় ‘টিউব’ আর টায়ার বসানোয় ব্যস্ত কালো জামা, কালো হাফ প্যান্ট। বয়স কত, জানতে চাইতেই এক লহমায় ছুট দিল চোখের আড়ালে। পাশের বাদামি জামা আর নীল জিন্‌সেরও একই ব্যস্ততা। একই প্রশ্নে একই রকম ছুট তারও।

Advertisement

অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়

নলহাটি শেষ আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০১৫ ০২:১১
Share:

ইস্পাতের ‘রিম’-এর ফাঁক দিয়ে ‘স্পোক’ বসানো শেষ। অভ্যস্ত দ্রুততায় ‘টিউব’ আর টায়ার বসানোয় ব্যস্ত কালো জামা, কালো হাফ প্যান্ট। বয়স কত, জানতে চাইতেই এক লহমায় ছুট দিল চোখের আড়ালে। পাশের বাদামি জামা আর নীল জিন্‌সেরও একই ব্যস্ততা। একই প্রশ্নে একই রকম ছুট তারও।

Advertisement

মুখ্যমন্ত্রী ঘোষিত সাইকেল বিলি প্রকল্পে কাজ করছে এমনই কিছু শ্রমিক, যাদের বয়স নিয়ে ধন্দ রয়েছে। বীরভূমের নলহাটি ২ ব্লক অফিস চত্বরে দেখা মেলা এই কিশোরদের শিশু-শ্রমিক বলে দাবি করে ইতিমধ্যেই সরব হয়েছেন বিরোধীরা। প্রশাসনের নাকের ডগায় বসে কী করে সরকারি প্রকল্পে শিশু-শ্রমিকদের কাজে লাগানো হয়েছে, তুলেছেন সে প্রশ্ন। শুধু ওই ব্লক অফিস নয়, নলহাটি ১ ব্লকের কুরুমগ্রাম মিত্রভূম হাইস্কুলের মাঠেও একই কাজে কাছাকাছি বয়সী কিশোরের দেখা মিলেছে।

যদিও নলহাটি ১ এবং নলহাটি ২— দু’টি ব্লকের বিডিও-ই দাবি করেছেন, ‘‘বিষয়টি জানা নেই। খোঁজ নিতে হবে।’’ জেলাশাসক পি মোহন গাঁধীর বক্তব্য, ঠিকাদার সংস্থা সাইকেল ফিটিংয়ের কাজ করছে। তারা সে কাজে শিশুশ্রমিক ব্যবহার করলে, তাতে বাধা দেওয়া হবে।

Advertisement

তবে খাস ব্লক অফিস চত্বরে কী করে বিতর্কিত শ্রমিক ব্যবহারের ঘটনা সরকারি আধিকারিকদের চোখ এড়িয়ে গেল, সে প্রশ্নের জবাব মেলেনি প্রশাসনের কোনও স্তরেই।

জেলা সদর সিউড়িতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আসার কথা আগামী ৩ ডিসেম্বর। সেখানে অন্য কর্মসূচির সঙ্গে কিছু সাইকেল বিলি করার কথাও রয়েছে তাঁর। মুখ্যমন্ত্রী সাইকেল বিলি করার পরে, ব্লক স্তরে শুরু হবে সাইকেল বিলি। নলহাটি ২ ব্লক অফিস চত্বরে তারই তোড়জোড় চলছে। বুধবার সেখানে বয়স জানতে চাওয়ায় যে কিশোরেরা পালাল, তারা সেই যে গেল, আর সামনে এল না।

তবে দলের অন্য শ্রমিকেরা জানালেন, উত্তরপ্রদেশের লখনউ থেকে ঠিকাদারের মাধ্যমে চুক্তির ভিত্তিতে ব্লকের ২,০০০ সাইকেল ফিটিং করার জন্য এসেছেন। নাম, ঠিকানা, ঠিকাদারের নাম, ফোন নম্বর কোনওটাই জানালেন না তাঁরা।

নলহাটি ১ ব্লকের স্কুলটিতে যে ছ’জনের দল সাইকেল ফিটিং করছে, তাদের মধ্যে তিন জনকে চোখের দেখায় নাবালক বলে মনে হলে, দোষ দেওয়া যায় না। তাদের মধ্যে আপাত ভাবে যে সবচেয়ে কমবয়সী, সে নিজের নাম জানাল আখতার আনসারি। বয়স বলল না। অন্য দু’জনের দাবি, তারা আঠারো পেরিয়েছে। দলের মধ্যে বয়স্ক মহসিন আনসারি জানালেন, তাঁরা এসেছেন উত্তরপ্রদেশের বহরাইচ থেকে। রাজস্থানের এক ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে ১,১৪০টি সাইকেল ফিটিং করার। সাইকেলপিছু ছ’জন ৫০ টাকা করে পাবেন। তাঁর দাবি, ‘‘আখতারের বয়স পনেরো বছর।’’

বিরোধীরা মনে করিয়ে দিয়েছেন, এক রাজ্য থেকে যে কোনও বয়সের শ্রমিক অন্য রাজ্যে কাজ করতে গেলে তাঁর বাসস্থান এবং কর্মস্থল—দু’রাজ্যের শ্রম দফতরেরই অনুমতি নিতে হয়। পক্ষান্তরে, ‘চাইল্ড লেবার রেগুলেশন অ্যান্ড প্রিভেনশন অ্যাক্ট’, ১৯৮৬ অনুযায়ী ১৪ বছর বা তার কমবয়সী শিশুদের শ্রমসাপেক্ষ কাজে লাগালে সংশ্লিষ্ট সংস্থার বিরুদ্ধে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মামলা করতে পারে প্রশাসন। তাঁদের অভিযোগ, এ ক্ষেত্রে কোনওটিই হয়নি।

মহকুমা সহকারী শ্রম কমিশনার (রামপুরহাট ) নিরুপম মণ্ডল জানান, সাইকেল ফিটিংয়ের কাজে ভিন্-রাজ্যের শ্রমিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে এখনও পর্যন্ত কেউ অনুমতি নেয়নি। এ ব্যাপারে তাঁর কাছে সংশ্লিষ্ট ব্লক থেকে কোনও খবরও আসেনি। মহকুমাশাসক (রামপুরহাট) সুপ্রিয় দাস বলেন, ‘‘এ রকম হওয়ার কথা নয়। খোঁজ করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’

জেলা চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটির চেয়ারম্যান নিত্যানন্দ রায় জানান, নলহাটিতে সাইকেল ফিটিংয়ের কাজে শিশু-শ্রমিক ব্যবহার করা হচ্ছে কি না, তা খোঁজ নিতে বলা হয়েছে জেলা চাইল্ড লাইনের লোকেদের।

তবে শ্রমিক সংগঠন সিটুর বীরভূম জেলা সম্পাদক শেখ ইসলামের অভিযোগ, ‘‘প্রশাসনের চোখের সামনেই শিশু শ্রমিকদের লাগানো হয়েছে সাইকেল ফিটিংয়ের কাজে। মুখ্যমন্ত্রীর নাম ওই প্রকল্পে জড়িয়ে রয়েছে বলে মুখে কুলুপ সব প্রশাসনিক কর্তার।’’

স্থানীয় নেতাদের মতোই অভিযোগ মানতে নারাজ রাজ্যের মন্ত্রী তথা জেলার তৃণমূল নেতা আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর বক্তব্য, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী নিজে শিশুশ্রমের প্রবল বিরোধী। বিরোধীরা আর কিছু না পেয়ে এই অভিযোগ করছে। তবুও সরকারি প্রকল্প ঘিরে এমন অভিযোগ ওঠা অভিপ্রেত নয়। প্রশাসনকে বলেছি, অবিলম্বে সত্য-মিথ্যা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নিতে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন