হৃতগৌরব ফেরাতে চায় কীর্ণাহার

জাতীয়তাবাদী আন্দোলন-সহ বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনে গৌরবজনক ভূমিকা পালনের ইতিহাস রয়েছে কীর্ণাহারের। রয়েছে ধারাবাহিক সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার সমৃদ্ধ ইতিহাসও। কিন্তু সাম্প্রতিক খাগড়াগড় বিস্ফোরণ-কাণ্ডে জঙ্গিযোগের অভিযোগে কীর্ণাহার এবং সংলগ্ন এলাকার নাম জুড়ে যাওয়ায় সেই গৌরবে লেগেছে কালির ছিটে। স্থানীয় শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষজন অন্তত তেমনটাই মনে করেন। তাঁরা চান, বিচ্ছিন্ন ওই ঘটনার মালিন্য ঘুচিয়ে স্বমর্যাদায় ফিরুক কীর্ণাহার।

Advertisement

অর্ঘ্য ঘোষ

কীর্ণাহার শেষ আপডেট: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০০:৩৩
Share:

জাতীয়তাবাদী আন্দোলন-সহ বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনে গৌরবজনক ভূমিকা পালনের ইতিহাস রয়েছে কীর্ণাহারের। রয়েছে ধারাবাহিক সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার সমৃদ্ধ ইতিহাসও। কিন্তু সাম্প্রতিক খাগড়াগড় বিস্ফোরণ-কাণ্ডে জঙ্গিযোগের অভিযোগে কীর্ণাহার এবং সংলগ্ন এলাকার নাম জুড়ে যাওয়ায় সেই গৌরবে লেগেছে কালির ছিটে। স্থানীয় শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষজন অন্তত তেমনটাই মনে করেন। তাঁরা চান, বিচ্ছিন্ন ওই ঘটনার মালিন্য ঘুচিয়ে স্বমর্যাদায় ফিরুক কীর্ণাহার।

Advertisement

কীর্ণাহার-সহ সংলগ্ন এলাকায় বহু স্বাধীনতা সংগ্রামীর জন্মভূমি। তাঁদের মধ্যে অন্যতম প্রয়াত কামদাকিঙ্কর মুখোপাধ্যায়। নেতাজীর অন্যতম সহকর্মী তথা ‘ইণ্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লিগে’র প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক দেবনাথ দাসও ছিলেন কীর্ণাহারের ভূমিপুত্র। কমিউনিষ্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা আব্দুল হালিমও ছিলেন স্থানীয় শিবচন্দ্র হাইস্কুলের ছাত্র। ১৯২৬ সালে, শিক্ষাবিদ জে এল বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সামসুদ্দিন হোসেনের নেতৃত্বে ১৯২২ সালে প্রথম প্রজা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় কীর্ণাহারে। জেলা কংগ্রেস সম্পাদক মণিলাল ঘোষের সভাপতিত্বে দ্বিতীয় প্রজা সম্মেলনে প্রজাস্বত্ব বিলের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষিত হয় চল্লিশের দশকে। বেগার প্রথার বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে প্রান দেন ক্ষেতমজুর কালো বায়েন। এই আত্মত্যাগের ইতিহাসের গায়ে তাই জঙ্গি-যোগের কালিমা কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না কীর্ণাহারবাসী। এলাকার সাহিত্য-সংস্কৃতির যে এতদিনের ইতিহাস, তাকেই মনে রাখতে চায় এই শহর।

সামাজিক আন্দোলনের পাশাপাশি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাসও গৌরবময় কীর্ণাহারের। সাহিত্য সাধনার প্রাণপুরুষ হিসাবে চণ্ডীদাসকেই স্মরণ করেন সাহিত্যসেবী মানুষজন। কীর্ণাহারে বসবাস কালেও চণ্ডীদাস বেশ কিছু পদ রচনা করেছিলেন, বলে তাঁরা মনে করেন। সাহিত্য সৃষ্টির জগতে জমিদার শিবচন্দ্র সরকারের ভূমিকাও ছিল উল্লেখযোগ্য। তিনি নারী শিক্ষার প্রসারের জন্য ‘পল্লীপাঠিকা’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। ওই গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছিলেন স্বয়ং সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। এছাড়াও যোগবশিষ্ঠ রামায়ণ, হংসদূতম, অভিজ্ঞান শকুন্তলম প্রভৃতি গ্রন্থের বাংলা অনুবাদও করেন তিনি। নিয়মিত রোজনামচাও লিখতেন। তত্‌কালীন সমাজ এবং রাজনীতি বিষয়ক মূল্যবান তথ্য সমৃদ্ধ সেই রোজনামচা ১৯১৯ সালে তদানীন্তন জেলাশাসক গুরুসদয় দত্ত সংগ্রহ করেন। সেটি বর্তমানে ব্রতচারী গ্রাম হিসাবে খ্যাত উত্তর ২৪ পরগনার জোকা’র সংগ্রহশালায় রয়েছে।

Advertisement

নিজস্ব উদ্যোগে ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারও গড়ে তোলেন শিবচন্দ্রবাবু। তাঁর বাড়িতে নিয়মিত ব্রাহ্মসমাজের সভা বসত। ওই সভায় একাধিকবার আচার্যের ভূমিকা পালন করেছেন মহর্ষি দেবন্দ্রনাথ ঠাকুর। সাহিত্যানুরাগে শিবচন্দ্রের বাড়িতে পা রেখেছেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজনারায়ণ বসু, ভুদেব মুখোপাধ্যায়, শম্ভুনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। শিবচন্দ্রবাবুর পরিবারের বর্তমান প্রজন্মের দাবি, সখ্যতার কারণে তাঁর হয়ে মাইকেল মধুসূদন দত্ত হাইকোর্টে একটি মামলা লড়েছিলেন।

কীর্ণাহার থেকেই ১৮৯৫ সালে প্রকাশিত হয় ‘বীরভূমি’। বাংলা ভাষায় প্রকাশিত প্রাচীন পত্রিকা গুলির অন্যতম ‘বীরভূমি’। ১৯৪১ সালে কৃষ্ণগোপাল চন্দ্রের উদ্যোগে স্থাপিত হয় রবীন্দ্র স্মৃতি সমিতি এবং পাঠাগার। ১৯৪৪ সালে ওই পাঠাগারেই শুরু হয় সাহিত্য আসর। সেই আসরে যোগ দিয়েছেন সজনীকান্ত দাস, শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, অন্নদাশঙ্কর রায়, কুমুদরঞ্জন মল্লিক প্রমুখেরা। ওই সাহিত্য আসরের মুখপত্র হিসাবে ভোলানাথ দত্তের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় হাতে লেখা পত্রিকা ‘শমী’। সেই ধারা আজও বর্তমান।

লৌহসার ওষুধ আবিষ্কারের পাশাপাশি কাব্য রচনায় জড়িয়ে রয়েছে নবীনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের নাম। অবধুতের সঙ্গেও কীর্ণাহার হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক রামশম্ভু গঙ্গোপাধ্যায়ের হৃদ্যতা ছিল। উদ্ধারণপুরের ঘাট রচনার শেষাংশ অবধুত তাঁর বাড়ি থেকেই লেখেন বলে অনুমান। রামশম্ভুবাবু নিজেও চণ্ডীদাস সমস্যা-সংক্রান্ত বই লিখে সমালোচক মহলে সাড়া ফেলেছিলেন। রচনা করেন আরও ৪ খানি উপন্যাস। ওই স্কুলেরই আর এক শিক্ষক নীলরতন মুখোপাধ্যায় চণ্ডীদাস পদাবলী সংগ্রহ প্রকাশ করেন। একসময় বীরভুমি পত্রিকারও সম্পাদনা করেন তিনি। ১৯৫২ সালে এম আবদুর রহমানের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় কবিতা সংকলন ‘বল্লরী’। তাতে লিখেছিলেন সৈয়দ মুজতবা আলি, নজরুল ইসলাম প্রমুখ। সেই সংকলনের ভূমিকা লেখেন ভাষাবিদ সুকুমার সেন। আশীর্বাণী পাঠান কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিক। রহমান সাহেব নিজেও গবেষণামূলক ২৪টি বই লেখেন।

এছাড়াও বিভিন্ন সময় প্রকাশিত হয়েছে স্বপন রায়ের সম্পাদনায় ‘চেতনা’, তারক সিনহার সম্পদনায় ‘ময়ূখ’, অসীম বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পদানায় ‘নির্ভিক’। নাসিম এ আলমের সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘কবিতা উত্‌সব’ পত্রিকাও খুবই জনপ্রিয়। ওই পত্রিকা গোষ্ঠীর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে ‘বীরভূমের কবি ও কবিতা’ এবং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘রাত্রির রদেভুঁ’র বিশেষ সংখ্যা। সম্প্রতি অরুণ রায়ের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে ‘শেক্সপিয়ার-৪৫০’ নামের স্মারক পত্রিকা। সাহিত্য কর্মী নাসিম এ আলম এবং অরুণ রায় বলেন, “কীর্ণাহারের সাহিত্য চর্চার ইতিহাস অত্যন্ত সমৃদ্ধ। পার্শ্ববর্তী এলাকাকেও অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে।” সাহিত্যের সঙ্গে শোলা শিল্পেও সুনাম রয়েছে এখানকার এক শিল্পীর। তিনি অনন্ত মালাকার। আর্ন্তজাতিক খ্যাতির পাশাপাশি শিল্পগুরু আখ্যা পেয়ে কীর্ণাহারের সুনাম বৃদ্ধি করেছেন অনন্ত।

নাট্যচর্চায় যুবসংঘ, অরুণ রায়ের ‘অ’, অসীম বন্দ্যোপাধ্যায়ের নবস্বাক্ষর নাট্য সমিতি, প্রশান্ত পাত্র এবং অভিজিত্‌ সাহার লক্ষীমাতা নাট্য সমিতি, তারক সিনহার ওমা নাট্য সংস্থা, বান্ধব সমিতি, ড্রামাটিক ক্লাব, মুক্তাঙ্গন ক্লাব, তরুণ সমিতি-সহ বেশ কিছু সংস্থার নাম জড়িয়ে রয়েছে। কীর্ণাহারে নাট্যচর্চার সূত্রপাত হয় মূলত ১৮৫১ সালে সরকার বাড়ির গোষ্টযাত্রা উপলক্ষ্যে থিয়েটারের মাধ্যমে। পরবর্তীকালে ওই থিয়েটার যাত্রার রূপ নেয়। ওইসব যাত্রায় সরকার বাড়ির সদস্যরাও অভিনয় করতেন। যাত্রার ব্যয় বহনের জন্য তখনকার দিনে প্রয়াত কিশোরকুমার সরকার ‘জোতকিশোর এস্টেট’ থেকে ৪০ টাকা বরাদ্দ করেন।

সেই ট্র্যাডিশন আজও রয়েছে। একই পালায় আজও নাতি শুভ্রজি, ছেলে বিবেকানন্দের সঙ্গে মঞ্চে নামেন সরকার বাড়ির বর্তমান প্রজন্ম। ৮২ বছরের সুখশঙ্কর সরকার বলেন, “একসময় যাত্রাপালা দেখতে দূর গ্রামের লোক ভেঙ্গে পড়ত বলে পূর্বপুরুষদের মুখে শুনেছি। নানান বিনোদনের দাপটে সেই ছবি হারিয়ে গিয়েছে ঠিকই, কিন্তু আমাদের পরম্পরা আজও বর্তমান।”

এত সমৃদ্ধি স্বত্ত্বেও কীর্ণাহারে আজও কোনও সরকারি মুক্তমঞ্চ তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ। কল্লোল ভবন এবং টাউন লাইব্রেরির প্রেক্ষাগৃহই একমাত্র ভরসা। সংস্কৃতিপ্রেমীদের দাবি, মুক্তমঞ্চ হলে সংস্কৃতি চর্চার প্রসার ঘটবে। নানুর ব্লকের বিডিও মৃণালকান্তি বিশ্বাস বলেন, “উপযুক্ত জায়গা পেলে মুক্ত মঞ্চের ব্যবস্থা করা হবে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন