TMCP

পরিচালন সমিতিতে টিএমসিপি-র প্রভাব নিয়ে উঠছে প্রশ্ন

২০১৭ সালের আইনে পরিচালন সমিতির নয়া গঠনে কলেজের রোজনামচায় শাসক দলের প্রভাবের বজ্রআঁটুনি আরও মজবুত হয়েছে বলেই অনেকে মনে করছেন।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১০ জুলাই ২০২৫ ০৭:৩৭
Share:

—প্রতীকী চিত্র।

তখন রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। দক্ষিণ কলকাতার একটি কলেজের পরিচালন সমিতিতে মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ সদস্যদের হস্তক্ষেপে জেরবার হয়ে মুখ্যমন্ত্রীর শরণাপন্ন হন সংশ্লিষ্ট অধ্যক্ষ। তাতে সমস্যার সমাধান হয়। ঘটনাটি ব্যতিক্রমী। ২০১৭ সালের আইনে পরিচালন সমিতির নয়া গঠনে কলেজের রোজনামচায় শাসক দলের প্রভাবের বজ্রআঁটুনি আরও মজবুত হয়েছে বলেই অনেকে মনে করছেন।

উত্তর কলকাতার একটি কলেজের অধ্যক্ষের কথায়, “কোনও সন্দেহ নেই, ক্ষমতা কমছে কলেজ কর্তৃপক্ষের। পরিচালন সমিতিতে সরকারি লোক হিসেবে শিক্ষক সংগঠনের লোকজন ছাড়া ছাত্রনেতারাও মজুত। তাঁদের মাধ্যমে শিক্ষাকর্মী বা অস্থায়ী কর্মী হিসেবে যাঁরা ঢুকছেন, তাঁরা পুরোদস্তুর শাসকদল-অন্ত-প্রাণ। এই অস্থায়ী কর্মীরা আবার কেউ কেউ প্রাক্তনী। ভোটহীন ছাত্র সংসদের নেতাদের সঙ্গে এই কর্মিবাহিনী বা প্রাক্তনী ব্রিগেডই এখন কলেজে ছড়ি ঘোরায়। বেশির ভাগ শিক্ষক তাঁদের তোয়াজ করে চলেন।” কসবার দক্ষিণ কলকাতা আইন কলেজে ছাত্রীর গণধর্ষণ-কাণ্ডে অস্থায়ী কর্মী তথা প্রাক্তনী মনোজিৎ মিশ্রের নাম উঠে আসার পরে শিক্ষাজগতে এটাই ‘মনোজিৎ মডেল’ আখ্যা পেয়েছে। সম্প্রতি কলেজে স্থায়ী শিক্ষাকর্মী নিয়োগের ভার কলেজ সার্ভিস কমিশনকে দিয়েছে রাজ্য। তবে তাতে পুরো সমস্যা মেটার নিশ্চয়তা নেই।

কলেজের পরিচালন সমিতিতে স্থানীয় পঞ্চায়েত সমিতি, পুরপ্রতিনিধি বা জেলা সভাধিপতি, বিধায়কের মতো কেউকেটারা আগেও থাকতেন। কিন্তু তখন কলেজের প্রতিনিধির সংখ্যা অনেক বেশি ছিল। ২০১৭ সালের সরকারি আইন কার্যকর হওয়ার আগে পরিচালন সমিতিতে চার জন শিক্ষক প্রতিনিধি এবং দু’জন শিক্ষাকর্মী প্রতিনিধি থাকতেন। অধ্যক্ষ তো থাকতেনই। ২০১৭ সালের আইনে পরিচালন সমিতির নয়া মডেলে অধ্যক্ষ এখনও পদাধিকার বলে সমিতির সচিব। কিন্তু কলেজের শিক্ষক প্রতিনিধি কমে তিন জন এবং শিক্ষাকর্মী প্রতিনিধি কমে এক জন হয়েছেন। আগে রাজ্য সরকারি প্রতিনিধি দু’জন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য দু’জন থাকতেন। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’জন ছাড়া সরকারি প্রতিনিধি দু’জন, উচ্চ শিক্ষা সংসদের সদস্য এক জন থাকেন। আগে সমিতি গড়ার পরে সভাপতিকে বেছে নেওয়া হত। এখন সরকার আগে থেকেই সমিতির সভাপতিকে বাছাই করে পাঠায়। এবং তিনি সাধারণত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বই হয়ে থাকেন। আজকের দু’জন সরকারি প্রতিনিধি বা উচ্চ শিক্ষা সংসদের সদস্যের মধ্যেও সাধারণত শাসক দলের শিক্ষক সংগঠন বা ছাত্র সংগঠনের লোকজনই দলে ভারী। সংশ্লিষ্ট সূত্রে প্রকাশ, শাসকের পছন্দের ব্যক্তিত্ব এমন শিক্ষক নেতা বা ছাত্র নেতা একাধিক কলেজে পরিচালন সমিতিতে রয়েছেন— এমন নমুনা নেহাতই কম নয়। পরিচালন সমিতির সভাপতি স্থানীয় বিধায়ককে কলেজের প্রবীণ অধ্যাপক নতজানু হয়ে প্রণাম করছেন, এমন দৃশ্যও শিক্ষাক্ষেত্রে দেখা যায়।

যোগেশচন্দ্র কলেজের অধ্যক্ষ পঙ্কজকুমার রায় সম্প্রতি তাঁর কলেজের পরিচালন সমিতিতে নানা আইন বহির্ভূত হস্তক্ষেপ নিয়ে অভিযোগ তুলেছেন। শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুকে চিঠি লিখে তিনি নিরপেক্ষ সংস্থা দিয়ে তদন্তের আর্জি জানান। পঙ্কজ বলেন, “৮-১০ বছরের চেষ্টায় পাশ করা কলেজের এক প্রাক্তনীকে উচ্চ শিক্ষা সংসদের প্রতিনিধি করে পরিচালন সমিতিতে ঢোকানোর চেষ্টা হয়েছিল। সমিতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি অরুণ চট্টোপাধ্যায় বলে এক সদস্যকে নিয়ে নানা সমস্যা হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁকে সরান। এখন উচ্চ শিক্ষা সংসদ তাঁকেই আবার প্রতিনিধি হিসেবে ফিরিয়েছে। যাঁর জায়গায় অরুণবাবুকে ফেরানোর কথা বলা হচ্ছে তিনি আদৌ কখনও কলেজের সমিতিতে ছিলেন না। বিভ্রান্তিকর, আইন বহির্ভূত ঘটনাবলি নিয়ে তদন্তের আর্জি জানিয়েছি।”

ওয়েবকুপার শীর্ষস্তরের এক সূত্র অবশ্য বলছেন, “শিক্ষক সংগঠনের লোকেরা তো বরাবরই কলেজে থাকতেন। তবে ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে সক্রিয় ভাবে যুক্ত কেউ থাকা নিয়ে কারও কারও আপত্তি আছে। তেমন কাউকে ইদানীং নতুন করে মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে না।’’

মনোজিতের ‘মেন্টর’ বা অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত দক্ষিণ কলকাতার ছাত্র-যুব নেতা সার্থক বন্দ্যোপাধ্যায় এখন তাঁর নিজের কলেজ আশুতোষের ‘বড় বাবু’ (হেড ক্লার্ক)। রয়েছেন একাধিক কলেজের পরিচালন সমিতিতে। উত্তর কলকাতার একটি কলেজে দীর্ঘদিন পরিচালন সমিতিতে আছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক নিগ্রহ-কাণ্ডে অভিযুক্ত গৌরব দত্ত মুস্তাফি। গৌরব অবশ্য সেই শিক্ষক তাঁকে আদালতে দাঁড়িয়ে ক্ষমা করেছেন বলে জানান। তৃণমূল ছাত্র পরিষদের রাজ্য সভাপতি তৃণাঙ্কুর ভট্টাচার্যও নৈহাটির ঋষি বঙ্কিম কলেজের পরিচালন সমিতির সদস্য। ন্যাকে এ+তকমা পেয়েছে সেই কলেজ। তিনি বলেন, ‘‘রাজ্যের ৫০০টি কলেজে সাকুল্যে ১৭ জন টিএমসিপি নেতা বা পদাধিকারী থাকতে পারেন। কিন্তু তাঁদের পরিচয়টা অনেক বড়। সার্থক দক্ষ প্রশাসক। গৌরব পিএইচডি রত মেধাবী ছাত্র।’’ তৃণাঙ্কুর মাইক্রোবায়োলজির গবেষক। তিনি বলেন, ‘‘পরিচালন সমিতিতে থাকা টিএমসিপির নেতারা যোগ্যতায় কারও থেকে পিছিয়ে নেই।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন

এটি একটি প্রিমিয়াম খবর…

  • প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর

  • সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ

  • সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে

সাবস্ক্রাইব করুন