জমি দখল করে ব্যবসা জোড়া হকারদের উচ্ছেদ করার চেষ্টা নতুন নয় রেলের। কিন্তু যত বারই তারা উচ্ছেদ অভিযানে নেমেছে, প্রতি ক্ষেত্রেই তৈরি হয়েছে বিশৃঙ্খলা, যার পিছনে রাজনৈতিক ‘সহানুভূতি’র স্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে। ফলে, উচ্ছেদের কথা শুনলেই বেআইনি হকারদের একাংশ রেলের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াচ্ছেন। বেআইনি দখলদারদের পুনর্বাসন দেওয়ার দাবি উড়িয়ে দিচ্ছে রেলও। ফলে, অবশ্যম্ভাবী হচ্ছে সংঘাত। তৈরি হয়ে যাচ্ছে মালদহের মতো পরিস্থিতি।
মালদহে সোমবার হকারদের সঙ্গে রেল রক্ষী বাহিনীর রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পরে, দখলদার ও তাদের রাজনৈতিক মদতের বিষয়টি ফের সামনে এসেছে। রেল কর্তারা জানান, ৬ জুন রেলমন্ত্রী সুরেশ প্রভু আসছেন রাজ্যে। এর পর উচ্ছেদ নিয়ে রেলের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে, সে সিদ্ধান্ত তিনিই নেবেন।
সারা বছরই নানা জায়গায় দখল হয়ে থাকা জমি থেকে দখলদারদের সরানোর চেষ্টা করে রেল। কখনও অভিযানের তীব্রতা বাড়ে, কখনও তা চলে ঢিমে তালে। এই উচ্ছেদ অভিযান চালাতে গিয়েই গত ডিসেম্বরে নদিয়ার কল্যাণীতে অবৈধ হকারদের সঙ্গে সংষর্ষ বেধে ছিল রেল রক্ষী বাহিনীর জওয়ানদের। আহত হন চার জওয়ান এবং ১০ জন হকার।
রেল সূত্রের খবর, উচ্ছেদ-অভিযানের তীব্রতা সম্প্রতি বেড়েছে উত্তর ২৪ পরগনার টিটাগড়ে চলন্ত ট্রেনে বোমা ফেটে ১৫ জন যাত্রী জখম হওয়ার পরে। ওই বিস্ফোরণের পরে রেল-কর্তারা টিটাগড় স্টেশনে গেলে, স্থানীয়রা স্টেশন এলাকায় দুষ্কৃতীদের আনাগোনা বন্ধ করার দাবিতে বিক্ষোভ দেখান। এর পরেই পূর্ব রেল কর্তৃপক্ষ সব স্টেশনে উচ্ছেদের নির্দেশ নতুন করে জারি করেন। কিন্তু টিটাগড়ে ওই নির্দেশ জারি হতেই মৌচাকে ঢিল পড়ে। রাজনৈতিক নেতাদের একাংশ রে-রে করে ওঠেন। অনেকে রেল-প্রশাসনের কাছে ওই নির্দেশ প্রত্যাহারের আর্জি জানান।
পূর্ব রেলের এক কর্তার দাবি, টিটাগড়ের তৃণমূল সাংসদ দীনেশ ত্রিবেদী (প্রাক্তন রেলমন্ত্রী) তাঁকে বলেছিলেন, ‘পুনর্বাসন না দিয়ে উচ্ছেদ করলে ধর্না শুরু করবেন হকারেরা’। দীনেশবাবু কথা মেনেছেন। তাঁর যুক্তি, ‘‘ট্রেনে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না রেল। তাই হকারদের উপরে দায় চাপাচ্ছে।’’ কিন্তু বেআইনি দখলদারদের পুনর্বাসন দেওয়া কি রেলের পক্ষে সম্ভব? দীনেশ বলছেন, ‘‘সেটা রেলের ভাবনা।’’
তবে প্রাক্তন রেলমন্ত্রীর ওই ‘সহানুভূতি’র কথা জেনে টিটাগড়ে উচ্ছেদের ব্যাপারে নাড়াচাড়া করেনি পূর্ব রেল। তারা নজর দেয় মালদহ ডিভিশনে, যেখানে মাস চারেক ধরেই প্রায় চারশো লাইসেন্সবিহীন হকারকে সরানোর চেষ্টা চলছিল। মঙ্গলবার সে কাজ করতে গিয়েই বাধে ধুন্ধুমার।
যাত্রী-স্বার্থে প্ল্যাটফর্ম চত্বর থেকে দখলদারদের যে সরানো প্রয়োজন, তা অস্বীকার করছেন না কোনও রাজনৈতিক নেতাই। কিন্তু তাঁরা হকার-স্বার্থকেও গুরুত্ব দিচ্ছেন। প্রাক্তন সিপিএম সাংসদ ও রেলের স্ট্যান্ডিং কমিটির প্রাক্তন চেয়ারম্যান বাসুদেব আচারিয়ার কথায়, ‘‘রেলের জমি দরকার। কিন্তু হকারেরা তো আজরেলের জমিতে বসেননি। তাঁদেরও তো ব্যবসার প্রয়োজন।’’ বাসুদেববাবুর দাবি, তিনি স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান থাকাকালীন এক রকম ঠিক হয়ে গিয়েছিল, রেলের জমিতে ব্যবসা করা হকারদের তালিকা তৈরি করে তাঁদের লাইসেন্স দেওয়া শুরু করবে পূর্ব রেল। সেটি হবে ‘পাইলট প্রজেক্ট’। সে প্রকল্পের কী হল? বাসুদেববাবুর জবাব, ‘‘কেন্দ্রে সরকার বদলের পরে কী হয়েছে জানি না।’’
আর এক প্রাক্তন রেল প্রতিমন্ত্রী অধীর চৌধুরীও বলছেন, ‘‘গায়ের জোরে নয়, আলোচনার মাধ্যমে পন্থা বার করতে হবে। কারণ, হকারেরা দীর্ঘদিন ধরে রয়েছেন।’’