শাসকের ঘরে সিবিআই

দলের উঁচুতলায় সারদার মই ধৃত রজত, মত গোয়েন্দাদের

সারদা মামলায় মঙ্গলবার গ্রেফতার করা হল তৃণমূল নেতা এবং রাজ্য পুলিশের প্রাক্তন ডিজি রজত মজুমদারকে। সারদা কেলেঙ্কারির তদন্তে নেমে এই প্রথম সরাসরি শাসক দলের কোনও নেতাকে গ্রেফতার করল সিবিআই। রজতবাবু তৃণমূল কংগ্রেসের অন্যতম সহ-সভাপতি। তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, তাঁকে ষড়যন্ত্র, প্রতারণা ও তহবিল তছরুপের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে।

Advertisement

কাজল গুপ্ত

কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৩:৩০
Share:

গ্রেফতারের পরে বুকে ব্যথা অনুভব করেন রজত মজুমদার। সিবিআই দফতর থেকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে। ছবি: শৌভিক দে।

সারদা মামলায় মঙ্গলবার গ্রেফতার করা হল তৃণমূল নেতা এবং রাজ্য পুলিশের প্রাক্তন ডিজি রজত মজুমদারকে। সারদা কেলেঙ্কারির তদন্তে নেমে এই প্রথম সরাসরি শাসক দলের কোনও নেতাকে গ্রেফতার করল সিবিআই। রজতবাবু তৃণমূল কংগ্রেসের অন্যতম সহ-সভাপতি। তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, তাঁকে ষড়যন্ত্র, প্রতারণা ও তহবিল তছরুপের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে।

Advertisement

সারদা কেলেঙ্কারিতে জড়িত সন্দেহে এর আগে ইস্টবেঙ্গলের কর্তা দেবব্রত সরকার ও তৃণমূল-ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী সন্ধির অগ্রবালকে গ্রেফতার করেছিল সিবিআই। দু’জনেই এখন জেল হেফাজতে। সিবিআই সূত্রে খবর, গত তিন দিন ধরে সাংসদ কুণাল ঘোষকে টানা জেরা করা হয়েছে। এ দিন রজতবাবু, ‘প্রাক্তন’ তৃণমূল নেতা আসিফ খান ও কুণালকে একে অন্যের মুখোমুখি বসিয়ে জেরার পরেই রজতবাবু সম্পর্কে বহু তথ্য বেরিয়ে আসে। তার পরেই তাঁকে গ্রেফতারের সিদ্ধান্ত হয়। মঙ্গলবার রাতে তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ সৃঞ্জয় বসুকে তলব করে চিঠি পাঠিয়েছে সিবিআই। আজ, বুধবার তাঁকে সল্টলেকের সিজিও কমপ্লেক্সে সিবিআই দফতরে হাজির হতে বলা হয়েছে।

সবিস্তার জানতে ক্লিক করুন।

Advertisement

সারদার সঙ্গে তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের যোগসাজশের অভিযোগ উঠেছিল প্রথম থেকেই। এই কেলেঙ্কারিতে প্রথম তৃণমূল নেতা হিসেবে সাংসদ কুণাল ঘোষকে গ্রেফতার করে রাজ্য পুলিশ। কুণালের অবশ্য দাবি ছিল, তৃণমূলের বিরুদ্ধে মুখ খোলাতেই তাঁকে সারদা কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সেই অভিযোগ অস্বীকার করে তাঁকে সাসপেন্ড করে দল।

কিন্তু এ দিন রজতবাবুকে গ্রেফতার করার সঙ্গে সঙ্গেই সারদা তদন্তের গতিপথ নয়া মোড় নিল বলে মনে করছেন সিবিআই অফিসারেরাই। তাঁদের একাংশের মতে, তাঁরা এত দিন তৃণমূল কংগ্রেসের দোরগোড়ায় ঘোরাঘুরি করছিলেন। রজতবাবুর গ্রেফতারের পরে কার্যত ঢুকে পড়েছেন শাসক দলের অন্দরে। বলা হচ্ছে, যাঁরাই বিভিন্ন সময়ে সারদার উচ্চপদে বসেছেন, দেখা যাচ্ছে তাঁরাই পরে তৃণমূল কংগ্রেসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছেন। যেমন, কুণাল এবং রজত।

সবিস্তার জানতে ক্লিক করুন।

গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে রজতবাবু তৃণমূলের বীরভূম জেলার পর্যবেক্ষক ছিলেন। অভিযোগ, এক সময় সারদার সঙ্গে শাসক দলের এক শীর্ষনেতার যোগসূত্রের কাজ করতেন রজতবাবু। তাদের তদন্তেও এমনটাই উঠে এসেছে বলে সিবিআই সূত্রের দাবি। সিবিআই গোয়েন্দায়ের অভিযোগ শুধু সারদার আর্থিক লেনদেনই নয়, সুদীপ্ত সেনের প্রতারণা ব্যবসার ছক, তাঁর সঙ্গে প্রভাবশালীদের যোগসাজশ, সুদীপ্তর পালিয়ে যাওয়া সব কিছুর পিছনেই পরিকল্পনাকারী হিসেবে রজতবাবুর হাত ছিল। এবং তাঁকে গ্রেফতার করার পরে তৃণমূলের ওই শীর্ষনেতার দোরগোড়ায় পৌঁছনো আরও সহজ হবে।

এ দিন নর্থ ব্লকে বসে কলকাতায় তদন্তের অগ্রগতির দিকে নজর রাখছিলেন সিবিআই অধিকর্তা রঞ্জিত সিন্হা। বিকেলে অফিস ছেড়ে যাওয়ার সময় তিনি জানিয়ে যান, কলকাতা থেকে ‘ব্রেকিং নিউজ’ আসতে চলেছে। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই সরকারি ভাবে রজতবাবুকে গ্রেফতার করার কথা জানায় সিবিআই।

সিবিআই-কে সারদা তদন্তের দায়িত্ব দেওয়ার সময় সুপ্রিম কোর্ট এই কেলেঙ্কারিকে একটি বড় ষড়যন্ত্র বলে অ্যাখ্যা দিয়েছিল। আদালত বলেছিল, এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা জড়িত রয়েছেন। এক সময়ে রাজ্য পুলিশের শীর্ষ পদ এবং বর্তমানে মুখ্যমন্ত্রীর হেলিকপ্টার সফরের দেখভালের দায়িত্বে থাকা রজতবাবুর গ্রেফতারের ঘটনা কার্যত সুপ্রিম কোর্টের সেই পর্যবেক্ষণের ফল বলেই মনে করছেন আইনজীবীরা।

এ দিন গ্রেফতারের পরেই আচমকা অসুস্থ বোধ করতে শুরু করেন রজতবাবু। সল্টলেকের সরকারি হাসপাতাল থেকে চিকিৎসক এসে তাঁকে পরীক্ষা করেন। তাঁর বুকের বাঁ দিকে ব্যথা হচ্ছিল বলে তিনি চিকিৎসককে জানান। সন্ধ্যার পরে তাঁকে নীলরতন সরকার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। রাতে তাঁর ইসিজি করানো হয়। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, ইসিজি রিপোর্টে কোনও অস্বাভাবিকতা মেলেনি। পরে রজতবাবুকে কার্ডিওলজি বিভাগে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেও কিছু পরীক্ষা করা হয়। কিন্তু তাতেও কিছু মেলেনি। মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসকেরা এসে তাঁকে পরীক্ষা করেন। তাঁরাও কিছু পাননি। কিন্তু রজতবাবু বারবারই বলতে থাকেন, তাঁর বুকের বাঁ দিকে ব্যথা হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত তাঁকে আইসিইউ-তে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালের সুপার দেবাশিস গুহ বলেন, “রজতবাবু নানা রকমের সমস্যার কথা বলছিলেন। তাই চিকিৎসকেরা ঝুঁকি নেননি।”

প্রথমত, ২০১২ সালের জুলাই মাসে সারদার টাকায় বিশ্ববঙ্গ সম্মেলনের মূল উদ্যোক্তা ছিলেন রজতবাবু। তাঁর সঙ্গে কুণালও ওই সম্মেলনে যোগ দিতে লাস ভেগাসে যান। এই সম্মেলন করার জন্য সুদীপ্ত সেনের কাছ থেকে চার কোটি টাকা নিয়েছিলেন রজতবাবু। ওই খাতে সেখানে বিলাসিতা ও অন্যান্য খাতে যে টাকা খরচ হয়েছিল তার সঠিক হিসেব তিনি দেখাতে পারেননি।

দ্বিতীয়ত, সিবিআইয়ের জেরার মুখে রজতবাবু বলেছিলেন, তিনি মাসিক ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকা বেতন নিতেন সারদা-র কাছ থেকে। কিন্তু নথি ঘেঁটে সিবিআই জানতে পেরেছে প্রতি মাসে ১০ লক্ষ টাকা নিতেন তিনি। সিবিআইয়ের কাছে সুদীপ্তর অভিযোগ, রজতবাবু বিভিন্ন ভাবে টাকা আদায় করতেন। এমনকী বেশ কয়েক বার জোর করে তাঁকে দিয়েও সাদা কাগজে সই করিয়ে নিয়েছিলেন। সারদার এক হিসেবরক্ষক সিবিআই-কে জানিয়েছেন, নিয়মিত যে বিল পেশ করে তিনি টাকা তুলতেন, তার অর্ধেকের বেশিই ছিল ৭৫ লক্ষ টাকা বা তারও বেশি অঙ্কের। এই টাকা রজতবাবুই নিয়েছেন, নাকি অন্য কেউ তা-ও দেখা হচ্ছে।

তৃতীয়ত, রজতবাবুকে সিবিআই প্রথম জেরা করে ১৪ অগস্ট। সে দিন সকালে কলকাতার পদ্মপুকুর রোডের বাড়িতে পৌঁছে তাঁকে ফোন করেন সিবিআই অফিসারেরা। তিনি তখন বোলপুরে ডাক পেয়ে কলকাতা আসেন। পদ্মপুকুরের ওই বাড়িতে রজতবাবুর স্ত্রী থাকেন। ছেলে থাকেন বিদেশে। সিবিআই অফিসারদের মতে অবশ্য কলকাতায় আরও কয়েকটি সম্পত্তি রয়েছে রজতবাবুর। সম্পত্তি কিনেছিলেন বোলপুরেও। সিবিআই সূত্রের খবর, সে দিন তিনি যে সব নথি দিয়েছিলেন তা পরে খতিয়ে দেখে সন্তুষ্ট হতে পারেননি গোয়েন্দারা।

এ দিন সকাল সাড়ে দশটায় রজতবাবু সল্টলেকে সিবিআই দফতরে ঢোকেন। দুপুর তিনটে পর্যন্ত তিনতলায় ডিআইজি-র দফতরে তাঁকে জেরা করা হয়। সেখান থেকে একতলায় নামিয়ে আনার সময়ে প্রশ্ন করা হলে বাঁকা সুরে বলেন, “ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের খেলা দেখতে এসেছি।” এর কয়েক ঘণ্টা পরেই গ্রেফতার হন রজতবাবু।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন