হাওড়ার কোনা এলাকার মধ্যবিত্ত পাড়া। রাস্তার ধারের বিশাল বাড়িটায় আজ দিনভর টিভি অন। ঠায় বসে রয়েছেন আটপৌরে চেহারার মা। অন্য দিন পুজো করতেই বেলা বয়ে যায়। আজ সে সবও সেরেছেন নমো নমো করেই। বৃষ্টির কলকাতায় ঝাপসা পথঘাট মাড়িয়ে দু’একটা টিভি চ্যানেলের লোক ভিড় করেছে বাড়িতে। কথা বলছে ছেলে জ্যোর্তিময়ের সঙ্গে। ওঁরও অফিসে যেতে আজ দুপুর গড়িয়ে গেল!
‘সাবধানে যাস’। মাঝারি চেহারাটা গলির বাঁক ঘুরতেই ফের টিভিতে চোখ। যদিও বার বার করে ছেলে বলেছে, ‘আর টিভি দেখো না।’
তবুও। মায়ের মন তো। ‘‘রোগা, কালো মেয়েটা আমার…কথা রাখল না। পাহাড়েই শুয়ে রয়েছে সেই কবে থেকে…।’’
তিনি জয়া গায়েন। ২১ মে ২০১৪-এ এভারেস্ট সামিটে গিয়ে নিখোঁজ ছন্দা গায়েনের মা।
‘‘ওরা যে মারা গেছে, সে খবর তো তবু পাওয়া গেল। আর আমার মেয়েটা? দু’বছর ধরে তো হিমালয়ের ওপর শুয়ে আছে। কোনও খোঁজ তো পেলাম না! কেউ যদি অন্তত ওর মরার খবরও দিত…’’ ডুকরে উঠলেন জয়া।
সে দিন মেয়েকে হারিয়েছিলেন। ঠিক দু’বছর বাদে এ বার ছেলেকে হারালেন জয়া। হ্যাঁ ছেলেই তো। রাজীব ভট্টাচার্য। গত ২১ মে ওই এভারেস্ট জয় করতে গিয়ে মৃত পর্বতারোহী ব্যারাকপুরের রাজীব গত দু’বছর ধরে তো জয়ার ছেলেই হয়ে উঠেছিলেন। ‘‘ছন্দা চলে যাওয়ার পর ওর দাদার সঙ্গে রাজীবের খুব ভাব হয়ে গিয়েছিল। পরশু দিন ও মারা গিয়েছে শুনে আমার ছেলে খুব ভেঙে পড়েছে। ও তো আমার ছেলেই হয়ে গিয়েছিল প্রায়। সারাক্ষণ আমাকে ভরসা দিত। বোঝাত ছন্দা ফিরবে না। তবুও আমি বলতাম, তোমরা তদন্ত কর। আমার মেয়ে ফিরবেই।’’ আঁচলে চোখ মোছেন জয়া। ‘‘আমার তো তবু ছেলেটা আছে। রাজীবের মা’র কী হবে বল তো? ওর তো একটাই ছেলে।’’
রাজীবের মা’কে চেনেন? কথা হয়েছে কখনও ওঁর সঙ্গে? ‘‘না। তবে আমি এই যন্ত্রণাই পেয়েছি। এখনও পাচ্ছি। ওর মায়ের যে ভেতরটা এখন কী হচ্ছে, আমি জানি।’’
ফের টিভিতে চোখ। কেন এমন হচ্ছে বলুন তো? সমস্যাটা কোথায়? উত্তর দিলেন ছন্দার দাদা জ্যোর্তিময় গায়েন। ‘‘সমস্যা তো একটা নয়। টাকা পয়সাটা বড় সমস্যা। এই যে যারা যায়, তাদের রেসকিউ পলিসি করা থাকে, আমাদের বাংলা থেকে ছেলেমেয়েরা অত টাকা কোথায় পাবে বলুন?’’ উদ্ধারকাজে কোনও সমস্যা চোখে পড়ছে? জ্যোর্তিময় বললেন, ‘‘দেখুন অনেক প্রতিকূলতা কাটিয়ে উদ্ধার করতে হয়। ছন্দার সময়ও আমাদের মনে হয়েছিল কেন এখনও কোনও খবর দিচ্ছে না। অধৈর্য হয়ে পড়েছিলাম। যারা উদ্ধার করতে গিয়েছিল তাদের ওপর রাগও হয়েছিল। কিন্তু ঠান্ডা মাথায় ভাবলে বোঝা যাবে যারা উদ্ধার করতে যাচ্ছে, তাদেরও অনেক সমস্যা হয়। ওই অত উচ্চতায় তারাও কতটা সুস্থ থাকবে সেটাও তো ভাবার বিষয়।’’
‘মারা গিয়েছেন পর্বতারোহী সুভাষ পাল। আর এক অভিযাত্রী সুনীতা হাজরার শারীরিক অবস্থা সঙ্কটজনক। আপাতত কাঠমান্ডুর হাসপাতালে চিকিত্সা চলছে। এখনও নিখোঁজ ব্যারাকপুরের গৌতম ঘোষ ও দুর্গাপুরের পরেশ নাথ। গত শুক্রবার বেস ক্যাম্প থেকে এভারেস্ট শৃঙ্গ জয়ের পথে রওনা দিয়েছিলেন ওঁরা। রবিবার দিনভর তাঁদের নিয়ে নানা খবর আসতে থাকে। একটা সময়ের পর থেকে তাঁদের আর খোঁজও পাওয়া যায়নি…’— সামনের টিভিতে খবর পড়ছেন পেশাদার অ্যাঙ্কর। দিনভর চলতে থাকা টিভিটা হঠাত্ মিউট করে দিলেন জয়া। কঠিন মুখে বললেন, ‘‘একটা কথা আমি আজ বলছি, আমি এখনও ছন্দার জন্য তদন্ত চাই। সত্যিই কোনও দুর্ঘটনা ঘটেছিল, নাকি ওকে ইচ্ছে করে কেউ মেরে ফেলল, সেটা আমাকে জানতেই হবে।’’
জয়ার চোখে তখন অকাল শ্রাবণ।
আরও খবর
ঘরে ফিরলেন না সুভাষ, হাসপাতালে লড়াই সুনীতার