কিশোরকে বাড়ি ফেরালেন ভিন্ রাজ্যের ‘চাচা’

কাজে ভুল করলেই ছ্যাঁকা, মারধর

পড়শির হাত ধরে কাজের আশায় উত্তরপ্রদেশের গোরক্ষপুরে গিয়েছিল চণ্ডীতলার বছর চোদ্দোর সোহেল শেখ। সেখানে পান থেকে চুন খসলেই কখনও জুটত মার, কখনও খেতে হতো কাঁচালঙ্কা, কখনও পশ্চাদ্দেশে ফোটানো হতো সূঁচ, কখনও দেওয়া হতো গরম খুন্তির ছ্যাঁকা— অভিযোগ এমনই।

Advertisement

প্রকাশ পাল

চণ্ডীতল‌া শেষ আপডেট: ৩০ জুন ২০১৬ ০১:২৬
Share:

বাড়িতে সোহেল। রয়েছে হাতে-পায়ে আঘাতের চিহ্ন। ছবি: দীপঙ্কর দে।

পড়শির হাত ধরে কাজের আশায় উত্তরপ্রদেশের গোরক্ষপুরে গিয়েছিল চণ্ডীতলার বছর চোদ্দোর সোহেল শেখ। সেখানে পান থেকে চুন খসলেই কখনও জুটত মার, কখনও খেতে হতো কাঁচালঙ্কা, কখনও পশ্চাদ্দেশে ফোটানো হতো সূঁচ, কখনও দেওয়া হতো গরম খুন্তির ছ্যাঁকা— অভিযোগ এমনই। নানা ‘অত্যাচারে’ সোহেল যখন কাহিল, তখন তাঁকে বাঁচিয়ে দিলেন রাস্তায় আলাপ হওয়া ‘রাকেশ চাচা’! মাস দেড়েক বাড়িতে রেখে তিনি ছেলেটির চিকিৎসা তো করালেনই, ফিরিয়ে দিলেন বাড়িতেও।

Advertisement

সোমবার বিকেলে বাড়ি পৌঁছেছে সোহেল। তার পর থেকে সে ‘রাকেশ চাচা’র কথাই বলে যাচ্ছে। আর রাগ উগরে দিচ্ছে পড়শি শেখ সামিউল্লা ও তাঁর পরিবারের উপরে। শেখ সামিউল্লার হাত ধরেই সোহেল মাস ছয়েক আগে গোরক্ষপুরে গিয়েছিল। বুধবার দুপুরে ছেলেটির বাড়ির লোক এবং অন্য পড়শিরা সামিউল্লাদের বাড়িতে ভাঙচুর চা‌লায় বলে অভিযোগ। ছেলেটির পরিবারের তরফে সামিউল্লাদের পরিবারের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগও করা হয়।

সোহেল বলে, ‘‘ওখানে আমাকে সোনার কাজ করানোর জন্য নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ঘরের সব কাজও করতে হতো। ভুল হলেই শুরু হয়ে যেত অত্যাচার। একবার রডের বাড়ি মেরে থাই ফাটিয়ে দেয়। গরম খুন্তির ছ্যাঁকা দেয়। এক দিন ধোওয়ার পরে হাঁড়িতে সাবান লেগে থাকায় জামাকাপড় খুলিয়ে শুকনো লঙ্কা পুড়িয়ে গোপনাঙ্গে লাগিয়ে হাত-পা বেঁধে ছাদে ফেলে রাখে। এক দিন বালতি ধুতে ভুলে যাওয়ায় আধ গ্লাস জলে অনেকগুলো কাঁচালঙ্কা খেতে বাধ্য করে।’’

Advertisement

পুলিশ জানায়, ঘটনাস্থল যে হেতু অন্য রাজ্য, সে জন্য চণ্ডীতলা থানার পক্ষে ঘটনার উপযুক্ত তদন্ত করা সম্ভব নয়। জেলা পুলিশের এক অফিসার বলেন, ‘‘ছেলেটির অভিযোগ গুরুতর। ওই রাজ্যের সংশ্লিষ্ট থানার সঙ্গে ছেলেটির বাড়ির লোক যোগাযোগ করলে ভাল হয়। আমাদের তরফেও ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায় কি না, তা দেখা হচ্ছে।’’

অভিযোগ মানতে চাননি সামিউল্লার দাদা, নাজিবুল্লা শেখ। তাঁর দাবি, ‘‘সোহেল আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে বলুক ওর উপর কোনও অত্যাচার হয়েছেল কিনা। আমাদের বিরুদ্ধে কেউ চক্রান্ত করে ওকে দিয়ে উল্টোপাল্টা অভিযোগ করাচ্ছে। ও গোরক্ষপুর থেকে এক মাস আগে নিখোঁজ হয়ে যায়। আমরা থানা-পুলিশ করেছি। এখন শুনছি ও বাড়ি ফিরেছে।’’

ছেলেবেলা থেকেই চণ্ডীতলার কুমিরমোড়ার পুরকাইতপাড়ায় মামাবাড়িতে থাকে সোহেল। স্থানীয় বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ত। কাজের আশায় সে সামিউল্লার হাত ধরে পাড়ি দেয় গোরক্ষপুরের কাছে তামকিন রোড এলাকায়। সেখানে সোনার দোকান চালায় সামিউল্লারা তিন ভাই এবং তাদের ভাগ্নে।

সোহেল পুলিশকে জানিয়েছে, ওই দোকানের কাছেই একটি বাড়ির তিনতলায় তারা থাকত। ঘুমনোর সময় বিদ্যুৎ চলে গেলে ওই চার জনকে হাতপাখা দিয়ে হাওয়াও করতে হতো তাকে। ঘুম পেয়ে গেলে জুটত বেধড়ক মার। কিন্তু বাড়ির লোক ফোন করলে বলতে হতো সে ভাল রয়েছে। কেননা, সামিউল্লারা পাশে বসে থাকত। অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে মাস দেড়েক আগে বাজার থেকে আম কিনতে বেরনোর নাম করে পালিয়ে যায় সে। রাস্তায় ইতস্তত ঘোরাফেরার সময়েই স্থানীয় বাসিন্দা রাকেশকুমার পাসোয়ানের সঙ্গে তার পরিচয় হয়।

অল্প সময়েই রাকেশকুমার সোহেলের ‘রাকেশ চাচা’ হয়ে যান। ‘চাচা’ই সোহেলের সুশ্রষা করেন। ওই পরিবারের যত্নে অনেকটাই সেরে ওঠে সোহেল। সে বলে, ‘‘প্রথম কয়েক দিন শুধু বিছানায় পড়েছিলাম। চাচা আমাকে খাবার, ওষুধ খাইয়ে দিত।’’

দিন কয়েক আগে এক পরিচিত মহিলার সঙ্গে সোহেলকে কলকাতার ট্রেনে তুলে দেন রাকেশকুমার। হাতে দেন ৪০০ টাকা। ফোনে যোগাযোগ করা হলে রাকেশকুমার বলেন, ‘‘এক দিন সকালে দেখি সোহেল রাস্তায় দাঁড়িয়ে কাঁদছে। অচেনা ছেলেটাকে ওষুধ কেনার জন্য দশ টাকা দিই। কিন্তু ওর শরীর খুব খারাপ ছিল। তাই বাড়িতে নিয়ে যাই। ওর পায়ে দগদগে ঘা, শরীরে ব্যথা ছিল। দেড় মাসে অনেকটাই সেরে ওঠে। যারা ছেলেটার উপর এ ভাবে অত্যাচার করেছে, তাদের শাস্তি হওয়া উচিত।’’

একই রকম শাস্তির কথা বলছেন সোহেলের মামারবাড়ির লোকেরাও। সোহেলের মামা মহম্মদ কুরবান বলেন, ‘‘চেনা পড়শিরা যে অমন অত্যাচার করবে, কে জানত? সোহেলকে বাঁচিয়ে দিলেন ওর অনাত্মীয় চাচা।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন