কটাক্ষের অমিত-বিক্রম

মতিভ্রম থেকে মাথা খারাপ, নিশানায় টাটা

বুধবার দমদম বিমানবন্দর থেকে পূর্ব কলকাতার পাঁচতারা হোটেলে যাওয়ার পথে রাজারহাটে শিল্পায়নের কোনও ছবি নজরে পড়েনি রতন টাটার। সে কথা জানানোর ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই তাঁকে বেনজির আক্রমণ করে রাজ্যের অর্থ ও শিল্পমন্ত্রী অমিত মিত্র বললেন, “ওঁর মতিভ্রম হয়েছে!” পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের মন্তব্য, “ওঁর মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে।”

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ অগস্ট ২০১৪ ০৩:৪২
Share:

বুধবার দমদম বিমানবন্দর থেকে পূর্ব কলকাতার পাঁচতারা হোটেলে যাওয়ার পথে রাজারহাটে শিল্পায়নের কোনও ছবি নজরে পড়েনি রতন টাটার। সে কথা জানানোর ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই তাঁকে বেনজির আক্রমণ করে রাজ্যের অর্থ ও শিল্পমন্ত্রী অমিত মিত্র বললেন, “ওঁর মতিভ্রম হয়েছে!” পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের মন্তব্য, “ওঁর মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে।”

Advertisement

কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই এর জবাব দিয়েছেন টাটা। টুইট করেছেন, “রাজ্যের শিল্পায়ন নিয়ে আমি কোনও মন্তব্য করিনি। কিন্তু রাজারহাটে কোনও শিল্পায়নের ছবি যদি আমার চোখ এড়িয়ে গিয়ে থাকে, অমিতবাবু সেটা দেখিয়ে দিন। যদি না পারেন, তা হলে আমাকে বলতে হবে যে, অমিত মিত্রের মস্তিষ্ক খুবই উর্বর।”

বণিকসভার ‘লেডিজ স্টাডি গ্রুপের’ অনুষ্ঠানে রতন টাটা সিঙ্গুর আর শিল্পায়ন নিয়ে মুখ খোলার পরের দিনই রাজ্য সরকারের তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখে শিল্পমহলের অনেকেই বলছেন, আসলে ভিমরুলের চাকে ঘা দিয়েছেন টাটা গোষ্ঠীর এমেরিটাস চেয়ারম্যান। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন রাজ্যে শিল্পের দৈন্যদশা। আর তাতেই আঁতে ঘা লেগেছে শাসক দলের।

Advertisement

কিন্তু শিল্পপতি থেকে রাজনীতিক প্রায় সকলকেই অবাক করেছে অর্থমন্ত্রীর অসৌজন্য। এ দিন বণিকসভা সিআইআই-এর তথ্যপ্রযুক্তি সংক্রান্ত আলোচনাসভায় সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে রতন টাটার পর্যবেক্ষণকে শুধু ‘মতিভ্রম’ বলেই ক্ষান্ত হননি তিনি। বলেছেন, “ওঁর অন্য যা হবি আছে, এরোপ্লেন ওড়ানো, এই সব করুন।” (ঘটনাচক্রে বুধবার নিজে বিমান চালিয়ে কলকাতা এসেছিলেন টাটা।)

প্রথম বিস্ময়, ভাষা প্রয়োগ নিয়ে। বাম আমলের শেষ পর্বে শুরু হওয়া কুবাক্যের স্রোত তৃণমূল জমানার তিন বছরে এসে কার্যত সর্বজনীন হয়ে পড়েছে। যার শেষতম সর্বোচ্চ উদাহরণ তৃণমূল সাংসদ তাপস পাল। কিন্তু রাজনীতির আঙিনায় এসে অমিত মিত্রের মতো মার্জিত ও মিতভাষী বলে পরিচিত মানুষের বদলটা রীতিমতো চোখে লাগছে শিল্পমহলের।

পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম অবশ্য অমিতবাবুকেও ছাপিয়ে গিয়েছেন। সিআইআই-এর অনুষ্ঠানেই তাঁর মন্তব্য, “কিছু লোক আছে যারা বাংলার ভাল চায় না। অন্ধেও রাজারহাট গেলে বুঝবে কতটা উন্নয়ন হয়েছে। রতন টাটা যেন দেবপুত্র। মাঝে মাঝে এসে দেববাণী দিয়ে চলে যাবেন। তার চেয়ে সামনে এসে রাজনীতি করুন।”

মন্ত্রীদের এহেন মন্তব্যের পরে বণিকসভা অ্যাসোচ্যামের এক প্রতিনিধি এ দিন বলেন, “রাজনীতিতে এলেই রুচির অভাব ঘটবে কেন? অমিতবাবু এত দিন ধরে শিল্পপতিদের খুব কাছ থেকে দেখেছেন। ওঁর এই ধরনের মন্তব্য খুবই দুঃখজনক।”

সমালোচনায় সরব হয়েছেন বিরোধীরাও। বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ বলেছেন, “তৃণমূলের অন্য নেতা-মন্ত্রী কখন কী বলবেন, তা বোঝা শিবেরও অসাধ্য! কিন্তু তা-ই বলে অমিত মিত্র? সম্পূর্ণ অন্য জগতে এসে ওঁর এই পরিণতি হয়েছে!” সোশ্যাল মিডিয়ায় অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ করেছেন অসংখ্য সাধারণ মানুষও। টুইট করে সেই সমর্থনকে স্বাগত জানিয়েছেন টাটা।

অমিতবাবুর আর একটা পরিবর্তনও বিস্ময় জাগাচ্ছে। ২০০৮-এর সেপ্টেম্বরে টাটাদের সিঙ্গুর ছাড়ার জল্পনা যখন শুরু হয়ে গিয়েছে, অমিত মিত্র তখন বণিকসভা ফিকির সেক্রেটারি জেনারেল। সেই সময় তিনি বলেছিলেন, “টাটারা যদি চলে যায়, তা হলে রাজ্যের পক্ষে সেটা বড় ধাক্কা হবে। শুধু দেশীয় লগ্নিকারীরাই নন, আস্থার অভাবে ভুগবেন বিদেশের শিল্পপতিরাও।” সেই অমিত মিত্রই আজ ন্যানো-বিদায়কে লঘু করে দেখানোর চেষ্টা করছেন! যা দেখে সিপিএম সাংসদ মহম্মদ সেলিমের মন্তব্য, “এত বড় ইউ-টার্ন, ভাবা যায় না! অমিত মিত্র ছিলেন শিল্পায়নের বড় সমর্থক, সিঙ্গুরের সময় তাঁর মতামত কেউ ভোলেনি। মদন মিত্র, ববি হাকিম, আরাবুল ইসলামদের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে তাঁরও এই অবস্থা হল?” আর কংগ্রেসের মানস ভুঁইয়া বলেন, “রতন টাটা কে এবং তাঁর কী যোগ্যতা, তৃণমূলের অন্য মন্ত্রীরা না জানতেও পারেন। ফিকি-র প্রাক্তন সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে অমিত মিত্র তো জানেন!’’

রাজ্যে শিল্পায়নের যে হতদরিদ্র দশার কথা রতন টাটা বলার চেষ্টা করেছেন, তার দিকেও এ দিন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। তাঁর মন্তব্য, “ওঁর (রতন টাটা) গোষ্ঠীর সংস্থা টিসিএস ৪০ একর জমিতে ক্যাম্পাস তৈরি করছে। অনিল অম্বানী ৬০০ কোটি টাকা বিনিয়োগে সিমেন্ট কারখানা তৈরি করছেন। রঘুনাথপুরে ইমামির প্রকল্প হচ্ছে। বলতে শুরু করলে সারা দিন কেটে যাবে। টাটা মেটালিকস সম্প্রসারণ করার আগ্রহ জানিয়ে চিঠি দিয়েছে। বিদ্যাসাগর শিল্পতালুকে টাটা হিতাচির বিরাট কাজ হচ্ছে। উনি হয়তো খবর রাখেন না।”

অমিতবাবু এই সমস্ত বিনিয়োগই তৃণমূল সরকারের কৃতিত্ব বলে দাবি করার চেষ্টা করলেও টিসিএস এবং টাটা হিতাচির লগ্নি প্রস্তাব এসেছিল বাম আমলেই। ২০০৮ সালে রাজারহাটে ৪০ একর জমি বাজার দরে কেনে টিসিএস। দু’-দু’বার জমির পুনর্বিন্যাস হয়। ক্যাম্পাস তৈরি হয়ে যাওয়ার কথা ছিল ২০১১ সালে। কিন্তু লালফিতের ফাঁসে আটকে যায় প্রকল্প। সেই সমস্যা মিটিয়ে দিতে অবশ্য এগিয়ে আসেন তৃণমূল সরকারের প্রথম শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০১২ সালে।

টাটা হিতাচি প্রকল্প ঘোষণা হয় ২০০৬ সালে। যে দিন ন্যানো প্রকল্প ঘোষণা করেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, সে দিনই টাটা হিতাচির প্রকল্পও ঘোষিত হয়। অর্থমন্ত্রীর এ দিনের মন্তব্যের প্রেক্ষিতে তাই এক শিল্পকর্তার মত যে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত আগেই নেওয়া হয়েছে, তার কাজ এগিয়ে যাবে, সেটাই তো স্বাভাবিক।

টাটা মেটালিকস-এর ক্ষেত্রে অবশ্য বিষয়টি অন্য রকম। ১০০০ কোটি টাকার বিনিয়োগের এই প্রস্তাব আটকে যায় বাম আমলে। এক লপ্তে ৪০০ একর জমি পাওয়া নিয়ে সমস্যা তৈরি হয়। অমিতবাবুর দাবি, সম্প্রতি আবার রাজ্যকে চিঠি দিয়েছে এই সংস্থা।

শিল্পমহলের প্রশ্ন, অমিতবাবুর মতো পোড় খাওয়া শিল্পব্যক্তিত্ব এমন বিভ্রান্তিমূলক তথ্য দিলেন কেন? তবে ঘটনা হল, গত তিন বছরে পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়নের ছবিটা নিয়ে বরাবরই ধোঁয়াশা রেখে দিয়েছেন অমিতবাবু। চলতি বছরের বাজেট বক্তৃতায় তিনি দাবি করেছিলেন, ২০১১-র মে থেকে রাজ্যে প্রায় ৭৮ হাজার কোটি টাকা লগ্নি এসেছে। কিন্তু তার মধ্যে কত টাকার প্রকল্প বাম আমলে পাশ হয়েছিল, সেই হিসেব তিনি দেননি।

শিল্প মহলের মতে, বাম জমানার শেষ পর্বে বুদ্ধবাবুর উদ্যোগে বেশ কিছু শিল্প প্রস্তাব আসতে শুরু করে। কিন্তু তৃণমূলের জমি আন্দোলনের জেরে ক্রমেই উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন শিল্পপতিরা। ন্যানো-বিদায় আরও বড় ধাক্কা দেয় তাঁদের আস্থায়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় এসে শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ না-করার নীতিতে অনড় থাকায় পরিস্থিতির বদল তো হয়নিই, বরং আরও খারাপ হয়েছে। যে রাজারহাটে একাধিক শিল্প প্রকল্পের জন্য জমি নির্ধারিত রয়েছে, সেখানে চোখ বুলিয়ে রাজ্যের হালটা মোটামুটি বুঝে ফেলেছেন দু’বছর পরে কলকাতায় পা-রাখা রতন টাটা।

এবং তাঁর পর্যবেক্ষণকেই এ দিন সত্যি প্রমাণ করেছে ওবেরয় গোষ্ঠী। বেঙ্গালুরু এবং গোয়াতে দু’টি নতুন হোটেল গড়তে এক হাজার কোটি টাকা লগ্নির কথা ঘোষণা করেছে তারা। কিন্তু দার্জিলিঙে সংস্থার হাতে ৫ একর জমি থাকলেও সেখানে হোটেল গড়ার পরিকল্পনা নেই। কেন? সংস্থার ভাইস চেয়ারম্যান এবং সিইও এস এস মুখোপাধ্যায়ের মন্তব্য, “যেখানে শিল্প সংক্রান্ত কাজকর্ম বেশি হবে, সেখানেই আমরা হোটেল গড়ার পরিকল্পনা করতে পারি। আপনারাই বলুন না, পশ্চিমবঙ্গে সেই সম্ভাবনা কতটা?” ওবেরয় গোষ্ঠীর কর্ণধার পি আর এস ওবেরয়-ও বলেছেন শিল্প সংক্রান্ত কাজকর্ম বৃদ্ধির সম্ভাবনা খতিয়ে দেখে তবেই কোনও রাজ্যে হোটেল গড়ার সিদ্ধান্ত নেন তাঁরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন