অশান্তি না হয়, ব্যাঙ্ক পাশে চাইল রাজ্যকে

রিজার্ভ ব্যাঙ্ক চাইছে এক রকম। বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলো বলছে আর এক রকম। আর এই টানাপড়েনের মাঝে খানিক অনিশ্চয়তার ছায়া এসে ঢেকে ফেলেছে আমজনতার নোট-ভাগ্য। গজিয়ে উঠছে অশান্তির আশঙ্কাও।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০১৬ ০৪:০৭
Share:

বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে পুলুশি নজরদারি। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।

রিজার্ভ ব্যাঙ্ক চাইছে এক রকম। বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলো বলছে আর এক রকম।

Advertisement

আর এই টানাপড়েনের মাঝে খানিক অনিশ্চয়তার ছায়া এসে ঢেকে ফেলেছে আমজনতার নোট-ভাগ্য। গজিয়ে উঠছে অশান্তির আশঙ্কাও। পাঁচশো, হাজার টাকার নোট বদল, জমা ও টাকা তোলার জন্য আজ, বৃহস্পতিবার থেকে ব্যাঙ্কে-পোস্ট অফিসে যে লম্বা লাইন পড়বে, সেটা মোটামুটি নিশ্চিত। কিন্তু পরিষেবা ঠিক না-থাকলে শান্তি বজায় রাখা যাবে কিনা, তা নিয়ে ব্যাঙ্ককর্তারা নিশ্চিত নন। অপ্রীতিকর পরিস্থিতি ঠেকাতে তাই বুধবার রাজ্য সরকারের দ্বারস্থ হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি।

স্টেট ব্যাঙ্কের বেঙ্গল সার্কেলের চিফ জেনারেল ম্যানেজার পার্থসারথি সেনগুপ্ত এ দিন নবান্নে গিয়ে রাজ্য পুলিশের ডিজি সুরজিৎ করপুকায়স্থের সঙ্গে দেখা করেন। নোট-কাণ্ড ঘিরে আগামী ক’দিন যাতে আইন-শৃঙ্খলায় সমস্যা দেখা না দেয়, সে জন্য বাড়তি নিরাপত্তা চেয়েছেন তিনি। রাজ্যের তরফে ভরসা দেওয়া হয়েছে, যথাযথ নিরাপত্তার বন্দোবস্ত করা হবে।

Advertisement

পাশাপাশি রাজ্য পুলিশের তরফে ব্যাঙ্ক-কর্তাদের বলা হয়েছে, পরিষেবাদানের ক্ষেত্রে ব্যাঙ্কও যেন সতর্ক থাকে। প্রয়োজনীয় সমস্ত রকম বাড়তি বন্দোবস্ত যেন নেওয়া হয়। এ দিন পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ টুইট করে জনগণকে আর্জি জানিয়েছে— নোট বাতিলের আচমকা সিদ্ধান্তের জেরে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির সমস্যা দেখা দিতে পারে। শান্ত থাকুন, পুলিশের সঙ্গে সহযোগিতা করুন। কলকাতা পুলিশও প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাঙ্কের শাখায় বাড়তি প্রহরা রাখছে।

ঘটনা হল, নোট বদল জমা ও তোলার ক্ষেত্রে প্রতিটি ব্যাঙ্ককে বাড়তি প্রস্তুতি নিতে বলেছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এ দিন আরবিআই কর্তারা ভিডিও কনফারেন্স করে প্রস্তুতির খোঁজখবর নেন। কিন্তু সেখানে ব্যাঙ্কগুলির তরফে একগুচ্ছ প্রশ্ন তোলা হয়েছে। কী রকম?

যেমন রিজার্ভ ব্যাঙ্ক বলছে, পরিস্থিতি সামলাতে প্রয়োজনে অবসরপ্রাপ্ত কর্মী নিয়োগ করুক ব্যাঙ্ক। ব্যাঙ্কিং করেসপন্ডেন্টদের কাজে লাগাক। দরকারে আরও টাকা তোলার যন্ত্র বসাক, প্রয়োজন পড়লে টাকা গোনার বাড়তি যন্ত্র বসাতেও যেন কালবিলম্ব করা না হয়। অন্য দিকে ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষদের বক্তব্য— এ সব মোটেই মুখের কথা নয়। তাঁদের যুক্তি— অবসরপ্রাপ্ত বা ব্যাঙ্কিং করেসপন্ডেন্টরা ব্যাঙ্ক কর্মী নন। ফলে তাঁদের হাতে ব্যাঙ্কের টাকা তুলে দেওয়া যাবে না। উপরন্তু রাতারাতি এত স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র বসানো অসম্ভব। তা ছাড়া পুরনো নোট বদল বা জমা নেওয়ার সময়ে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক যে রকম ‘নিবিড়’ নজরদারি চাইছে, বর্তমান পরিকাঠামোয় তা কার্যত অসম্ভব।

নোট বদল পর্বে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক আরও বেশ কিছু ব্যবস্থা চাইছে। যেমন, টাকা বিনিময়ের জন্য ব্যাঙ্কে কাউন্টার বাড়াতে বলেছে তারা। পরামর্শ দিয়েছে নিরাপত্তারক্ষী বাড়ানোর। বেসরকারি সিকিওরিটি এজেন্সি থেকে রক্ষী নিতে কোমর বেঁধেছে ব্যাঙ্কগুলি। তবে বেসরকারি ব্যাঙ্কের এক কর্তা জানিয়েছেন, চাহিদা হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় এজেন্সিগুলো গার্ড জোগাতে হিমসিম খাচ্ছে।

জেনে রাখুন

•আজ ব্যাঙ্ক খুলছে

•চালু হতে পারে কিছু এটিএম। তবে পরিষেবা কিছুটা ব্যাহত হওয়ার সম্ভাবনা

•শনি ও রবিবার ব্যাঙ্ক খোলা। দু-এক দিন কিছু ব্যাঙ্ক খোলা থাকতে পারে একটু বেশি সময়

•ব্যাঙ্ক ও ডাকঘর পুরনো ৫০০, ১০০০ টাকার নোট জমা নেবে

•এটিএম চালু হলে, ১৮ তারিখ পর্যন্ত প্রতি ডেবিট কার্ডে দিনে ২০০০ টাকা পর্যন্ত তোলা যাবে। ১৯ শে থেকে বেড়ে হবে ৪,০০০

•আপাতত সরাসরি ব্যাঙ্ক থেকে (এটিএম ধরে) তুলতে পারবেন দিনে ১০,০০০ টাকা পর্যন্ত। সপ্তাহে ২০,০০০

• অচল নোট ভাঙিয়ে/ পাল্টে দেবে ব্যাঙ্ক ও ডাকঘর। ২৪ তারিখ অবধি প্রতি জনকে ৪,০০০ টাকা পর্যন্ত অঙ্কের পুরনো নোট বদলে দেওয়া হবে। ২৫শে থেকে তা বাড়বে। এ জন্য ভরতে হবে ফর্ম

•পরিচয়পত্র হিসেবে সঙ্গে রাখুন আধার কার্ড, ড্রাইভিং লাইসেন্স, ভোটার আইডি কার্ড, পাসপোর্ট, এনরেগা কার্ড, প্যান কার্ড, সরকারি কর্মীদের পরিচয়পত্র

•আড়াই লাখের বেশি পুরনো নোট জমায় আয়কর নজরদারি। ফাঁকি ধরা পড়লে দিতে হবে কর, সঙ্গে ২০০% জরিমানা

•রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কন্ট্রোল রুমের নম্বর: ০২২-২২৬০২২০১/ ২২৬০২৯৪৪

ব্যাঙ্ক অফিসারেরা বলছেন, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নির্দেশিকা মোতাবেক, কোনও গ্রাহক নির্দিষ্ট পরিচয়পত্র নিয়ে ব্যাঙ্কের কোনও শাখা থেকে দিনে সর্বোচ্চ চার হাজার টাকা মূল্যের ৫০০ বা ১০০০ টাকার নোট পাল্টে নিয়ে যেতে পারেন। কিন্তু একই গ্রাহক যদি এ ভাবে অন্য কোনও শাখায় পুরনো নোট পাল্টাতে যান, তা হলে ধরা যাবে কী করে?

আরবিআই নির্দেশিকায় এর কোনও সমাধানসূত্র বাতলানো নেই বলে ব্যাঙ্ক-কর্তাদের অনুযোগ। ওঁরা এ-ও বলছেন, এখন ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা পুরোটাই অনলাইন পদ্ধতিতে হয়। সেই প্রক্রিয়ায় ‘টাকা বদল’ সংক্রান্ত এন্ট্রির কোনও সুযোগ (অপশন) নেই। ফলে কাজটা পুরোটাই করতে হবে হাতে হাতে। ‘‘যা সময়সাপেক্ষ তো বটেই, পদে পদে বিভ্রাট বা জটিলতা দেখা দেওয়ারও সমূহ আশঙ্কা।’’— পর্যবেক্ষণ এক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের অফিসারের। এবং ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট না-থাকলেও কেওয়াইসি দিয়ে টাকা পাল্টে আনা যাবে— এই নির্দেশিকাও ওঁদের চিন্তা বাড়িয়েছে।

টাকা তোলার দৈনিক ঊর্ধ্বসীমা আরবিআই যে ভাবে দশ হাজারে বেঁধে দিয়েছে, তার কার্যকারিতা নিয়েও সন্দিহান ব্যাঙ্ক-কর্তাদের অনেকে। ‘‘এখন যে কারও পকেটে একাধিক পরিচয়পত্র। আধার কার্ড, ড্রাইভিং লাইসেন্স, প্যান কার্ড ইত্যাদি। এক-এক রকম আইডি দেখিয়ে কেউ যদি একই ব্যাঙ্কের বিভিন্ন ব্রাঞ্চে গিয়ে দশ হাজার টাকা তুলে নেন?’’— প্রশ্ন এক বেসরকারি ব্যাঙ্কের অফিসারের।

এরও উত্তর আরবিআই গাইডলাইনে দেওয়া নেই বলে ওঁদের দাবি। ব্যাঙ্ক-কর্তারা জানাচ্ছেন, টাকা তোলার সর্বোচ্চ সীমা পেরিয়ে গেলে সফটওয়্যারে কোনও সতর্কতামূলক ‘পপ-আপ’ যদি আসত, তা হলে এটা ঠেকানো সম্ভব ছিল। কিন্তু বর্তমান ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থায় তেমন সংস্থান নেই। অফিসারদের মতে, কেউ চাইলে এর সুযোগ বিলক্ষণ নিতে পারেন। এক ব্যক্তি একাধিক শাখায় গিয়ে দিব্যি দশ হাজার টাকা করে বার বার তুলে নিয়ে যেতে পারেন। একই শাখাতেও ঘুরে-ফিরে আসতে পারেন, অন্য আইডি হাতে। আটকানো সহজ হবে না।

আরও বড় সমস্যা— বিভিন্ন কর্পোরেট সংস্থার দৈনিক টাকা তোলার সীমা দশ হাজারে বাঁধা হয়েছে। কিন্তু চা-বাগান, নির্মাণসংস্থা কিংবা বড় ঠিকাদার কোম্পানিতে শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি মেটাতে হয়। তারা দিনে দশ হাজারের বেশি তুলতে না-পারলে মুশকিল। যদিও রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কর্তারা এ দিন এ প্রসঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে বলেছেন, জনধন যোজনায় অসংখ্য অ্যাকাউন্ট তৈরি হয়েছে, যেগুলো শুধুমাত্র ভর্তুকি বিলিতে ব্যবহৃত হয়। শ্রমিকদের মজুরিও যাতে ওই অ্যাকাউন্টে পাঠানো যায়, সে ব্যাপারে কর্পোরেট সংস্থাদের উদ্যোগী হতে বলছে আরবিআই।

কিন্তু প্রত্যন্ত এলাকায় বহু লোকেরই ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নেই। বস্তুত কোনও ব্যাঙ্কের শাখাই নেই। ওখানে কী হবে? উত্তর মেলেনি।

পোস্ট অফিস নিয়েও যথেষ্ট চিন্তা। কারণ, পরিকাঠামোর বিচারে ব্যাঙ্কের তুলনায় তারা এখনও পিছিয়ে।

সব মিলিয়ে ব্যাপারটা যে কী দাঁড়াচ্ছে, আজ বেলা গড়ালেই তার আন্দাজ মিলবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন