আসানসোলে বেসরকারি ডিগ্রি কলেজের উদ্বোধনে রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও শ্রমমন্ত্রী মলয় ঘটক। শনিবার শৈলেন সরকারের তোলা ছবি।
ধর্ষণ থেকে গুন্ডামি— হইচই হতেই ‘ছোট ঘটনা’ বলে ঝেড়ে ফেলার রাস্তা দেখিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
তাঁর দেখানো রাস্তাতেই হাঁটলেন রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী তথা তৃণমূলের মহাসচিব তথা পার্থ চট্টোপাধ্যায়। শনিবার আসানসোলে গিয়ে রাজ্যে পরপর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হামলা নিয়ে তিনিও বললেন, ‘‘চার-পাঁচটি ছোট ছোট ঘটনা ঘটেছে। এমন ভাবে প্রচার করছেন যেন কত কিছু হয়ে গিয়েছে।’’
২১ জুলাইয়ের মঞ্চ থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সম্মান করার বার্তা দেওয়ার পরের দিনই আসানসোলের রহমানিয়া উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলে ঢুকে অঙ্কের শিক্ষককে মারধরের অভিযোগ ওঠে তৃণমূলের কিছু নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে।
সংবাদমাধ্যম সে প্রসঙ্গ তুলতেই পার্থ বলেন, ‘‘এ রকম ছোট-ছোট ঘটনা দেখাচ্ছেন। সব সময় খারাপ জিনিস দেখাচ্ছেন। এই সব দেখেই খারাপের প্রবণতা বাড়ছে। ভাল জিনিস দেখালে কমে যাবে।’’
প্রত্যাশিত ভাবেই, বিরোধীদের বিদ্রুপের লক্ষ্য হচ্ছেন শিক্ষামন্ত্রী। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য সুজন চক্রবর্তীর দাবি, ‘‘ওঁরা যা বলেন, তার উল্টো হয়। দু’দিন আগেই সিন্ডিকেট প্রসঙ্গে তা দেখেছি। পার্থবাবু ছোট ঘটনা বলছেন মানে এটা বড় ঘটনা।’’ বিজেপির শমীক ভট্টাচার্যের মতে, ‘‘এখনও শিক্ষক-শিক্ষিকা খুন হননি বলে বোধ হয় মন্ত্রীর মনে হচ্ছে ছোট ঘটনা! শিক্ষক নিগ্রহ
যে কত বড় সামাজিক অবক্ষয়, তা মন্ত্রী বুঝছেন না।’’ প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর কটাক্ষ, ‘‘সংবাদমাধ্যম সত্যটা দেখাতে চাইছে বলেই ওঁদের গায়ে ঝাল লাগছে!’’
এ দিন একটি বেসরকারি কলেজ উদ্বোধন শিক্ষামন্ত্রী আসানসোলে যান। শিক্ষককে মারধর ‘ছোট ঘটনা’ বলে উড়িয়ে দিলেও পার্থর দাবি, ‘‘সরকার যথেষ্ট কড়া বলেই উপযুক্ত ব্যবস্থা নিচ্ছে। এ বিষয়ে সরকার কোনও দল বা ঝান্ডা দেখছে না। আসানসোলেও এর অনেক প্রমাণ রয়েছে।’’ যে প্রসঙ্গে সুজনের পাল্টা প্রতিক্রিয়া, ‘‘কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার সাহস ওঁর নেই। শিক্ষামন্ত্রী নিজেও এই বাহিনীর ভয়ে সন্ত্রস্ত হয়ে আছেন!’’
পরে অবশ্য রহমানিয়া স্কুলে হামলায় মূল অভিযুক্ত, তৃণমূল নেতা
গোলাম সরওয়ার ও তাঁর ঘনিষ্ঠ অনুগামী দীপক গুপ্তকে বহিষ্কার করা হয়। সূত্রের খবর, কলেজের অনুষ্ঠান শেষে পার্থবাবু এডিডিএ-এর অতিথিশালায় দলের আসানসোলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। আসানসোলে শিক্ষক নিগ্রহের ঘটনায় কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে জানতে চান। দল এখনও ব্যবস্থা নেয়নি শুনে রেগে যান মন্ত্রী। সঙ্গে সঙ্গে দুই নেতাকে বহিষ্কারের নির্দেশ দেন। তৃণমূলের আসানসোল জেলা সভাপতি ভি শিবদাসন বলেন, ‘‘মন্ত্রীর সিদ্ধান্ত জানিয়ে দু’জনকে চিঠি পাঠাচ্ছি।’’ মন্ত্রী ‘ছোট ঘটনা’ বলার পরেও বহিষ্কার কেন? শিবদাসন বলেন, ‘‘পার্থবাবু মহাসচিব। তিনি যা নির্দেশ দিয়েছেন, আমরা কার্যকর করেছি মাত্র।’’
কে এই গোলাম সরওয়ার? স্থানীয় সূত্রেরখবর, ২০০৯-এ কংগ্রেসের টিকিটে জিতে কাউন্সিলর হলেও ২০১৩-য় তৃণমূলে যোগ দেন গোলাম। তৃণমূলের একটি অংশের দাবি, আসন্ন আসানসোল পুরভোটে তাঁর টিকিট পাওয়া প্রায় নিশ্চিত ছিল। ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা দীপক গুপ্ত তাঁর ছায়াসঙ্গী হিসেবে পরিচিত। রাত পর্যন্ত বহিষ্কারের চিঠি পাননি জানিয়ে গোলাম বলেন, ‘‘দলের সিদ্ধান্ত মানতেই হবে। তবে আরও তদন্ত করতে হতো।’’ তাঁর দাবি, সরকারের নির্দেশ সত্ত্বেও স্কুল পরিচালন সমিতির নতুন সভাপতির হাতে নথি দিচ্ছিলেন না প্রধান শিক্ষক। নিজেও অনুপস্থিত ছিলেন। স্কুলে পঠনপাঠন হচ্ছিল না। কিছু অভিভাবক তা নিয়ে কথা বলতে গেলে এক শিক্ষক দুর্ব্যবহার করেন। অভিভাবকেরা তার প্রতিবাদ করেছিলেন। গোলামের দাবি, ‘‘সে দিন আমার কোনও ভূমিকা ছিল না।’’
পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণ থেকে জামুড়িয়ার শ্যাম সেল কারখানায় অচলাবস্থা— এর আগে একের পর এক গোলমালে ‘ছোট ঘটনা’র তকমা দিয়েছেন মমতা। ভাবমূর্তি বাঁচাতে অভিযুক্তকে দল থেকে তড়িঘড়ি বহিষ্কারের নজিরও ভূরি-ভূরি। কিন্তু শ্যাম সেলে হুজ্জুতিতে অভিযুক্ত অলোক দাস বা দুর্গাপুরের কারখানায় তাণ্ডব চালানো অসীম প্রামাণিক— ‘বহিষ্কৃত’ বহু নেতাকেই দলের নানা কর্মসূচিতে দেখা যায়।
এ ক্ষেত্রেও কি তারই পুনরাবৃত্তি হবে? তৃণমূলের আসানসোল জেলা সভাপতি ভি শিবদাসন শুধু বলেন, ‘‘ওই দু’জনকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগও দেওয়া হবে। দশ দিনের মধ্যে তাঁদের জবাব দিতে হবে। তা কলকাতায় দলীয় নেতৃত্বের কাছে পাঠানো হবে।’’