আগে আমার কথা শুনুন। নবান্নের প্রেস কর্নারে অমিত মিত্র। পাশে সঞ্জীব গোয়েন্কা। নিজস্ব চিত্র
নবান্নে তাঁদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করা নিয়ে অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলেন সাংবাদিকেরা। তিনি শুনতেই চাননি। প্রতিবাদে অর্থমন্ত্রীর ডাকা সাংবাদিক বৈঠক ছেড়ে বেরিয়ে আসেন সাংবাদিকেরা। এ রাজ্যে এমন ঘটনা কার্যত নজিরবিহীন বলছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের একাধিক মন্ত্রীই।
নবান্নে মন্ত্রী-অফিসারদের সঙ্গে দেখা করার ব্যাপারে সাংবাদিকদের উপরে নিষেধাজ্ঞা এনে নির্দেশিকা জারি হয়েছে চলতি বছরের গোড়া থেকেই। কিন্তু এত দিন তা নিয়ে পুলিশের বিশেষ গা ছিল না। কড়াকড়ি শুরু হয় গত কয়েক দিন ধরে। বলা হয়, পুলিশের অনুমতি না-নিয়ে সাংবাদিকরা নির্দিষ্ট এলাকার বাইরে কোথাও যেতে পারবেন না। এই নিয়ম অমান্য করলে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৮৮ ধারা এবং সরকারি গোপনীয়তা আইন অনুযায়ী ৬ মাস থেকে ১৪ বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে।
সোমবার বেলা তিনটে নাগাদ নবান্নের প্রেস কর্নারে সাংবাদিক বৈঠক করতে আসেন অর্থ তথা শিল্পমন্ত্রী। উদ্দেশ্য, জানুয়ারিতে কলকাতায় সরকারি উদ্যোগে যে বিশ্ব বঙ্গ শিল্প সম্মেলন হতে চলেছে, তার প্রস্তুতির কথা জানানো। সঙ্গে ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ শিল্পোন্নয়ন নিগমের ম্যানেজিং ডিরেক্টর কৃষ্ণ গুপ্ত ও শিল্পপতি সঞ্জীব গোয়েন্কা। অমিতবাবু তাঁর বক্তব্য শুরু করার আগেই তাঁকে গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ, ও গ্রেফতারের হুঁশিয়ারি নিয়ে কিছু বলতে চান সাংবাদিকরা। কিন্তু অমিতবাবু কোনও কথা শুনতেই চাননি। সাংবাদিকরা ফের ওই প্রস্তাব রাখলে তিনি বলেন, “আগে আমাকে কনস্ট্রাকটিভ (গঠনমূলক) কাজটা করতে দিন। পরে শুনছি।”
সাম্প্রতিক কালে মন্ত্রী-আমলাদের সাংবাদিক বৈঠকের অভিজ্ঞতা হল, তাঁরা নিজের কথাটুকু বলেই পোডিয়াম ছেড়ে চলে যান। সাংবাদিকদের কোনও প্রশ্নের জবাব পর্যন্ত দেন না। সেই কারণে গোড়াতেই অর্থমন্ত্রীকে তাঁদের কথা শোনানোর জন্য অনুরোধ করেন সাংবাদিকেরা। তিনি তাতে রাজি না হওয়ায় সাংবাদিকরা বেঁকে বসেন এবং ঘর ছেড়ে চলে যান। এর পরে প্রায় ফাঁকা ঘরে মিনিট কয়েক নিজের বক্তব্য বলেন অর্থমন্ত্রী। তার পর ফিরে যান সপার্ষদ।
গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গেই কেন কথা বলতে চাইছিলেন সাংবাদিকেরা? কারণ, নবান্ন সূত্রে খবর এত দিন নিষেধাজ্ঞা শিথিল থাকলেও সম্প্রতি কয়েক জন সাংবাদিক অর্থমন্ত্রীর দফতরে যাওয়ার পরেই কড়াকড়ি শুরু হয়েছে। নবান্নের একাধিক সূত্র বলছে, সাংবাদিকদের উপস্থিতির কথা জেনে অর্থমন্ত্রী সরাসরি পুলিশকে ফোন করে কৈফিয়ত তলব করেন। তার পর থেকেই নিষেধাজ্ঞা কঠোর ভাবে বলবৎ করতে শুরু করে পুলিশ। গত শনিবার সাংবাদিকদের ডেকে সে কথা জানিয়েও দেন ডিসি (রিজার্ভ ফোর্স) অশেষ বিশ্বাস।
কিন্তু অমিতবাবু এ দিন যে ভাবে সাংবাদিকদের বক্তব্য শুনতে অস্বীকার করেন, তাতে বেশ হতবাক হয়ে পড়েন উপস্থিত তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের কর্তারা। সঞ্জীব গোয়েন্কার মতো প্রশাসনের বাইরের এক জন ব্যক্তির সামনে এমন ঘটনা ঘটায় অস্বস্তিতেও পড়েন তাঁরা। অমিতবাবুর অস্বস্তিও কিছু কম ছিল না। অর্থ দফতরের এক কর্তা বলেন, “দোতলা থেকে ফিরে আসার পরে মন্ত্রীর মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছিল না।” নবান্ন সূত্রের খবর, কিছু ক্ষণের মধ্যেই সুন্দরবনে সফররত মুখ্যমন্ত্রী গোটা ঘটনা জেনে যান। একাধিক মন্ত্রীই তাঁকে ফোন করে নবান্নের ঘটনা জানিয়ে দেন। এমনকী, বিধানসভাতেও পৌঁছে যায় সেই খবর।
দিনের শেষে বিধানসভার বাইরে শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “সাংবাদিকেরা আমাদের বন্ধু। যা ঘটেছে, তা অভিপ্রেত নয়।” সাংবাদিক না অর্থমন্ত্রী কার আচরণ অনভিপ্রেত, তা অবশ্য খোলসা করেননি পার্থবাবু। যদিও মমতার ঘনিষ্ঠ এক মন্ত্রীর কথায়, “সাংবাদিকদের মাধ্যমেই সরকার নিজের কাজ ও কথা মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়। প্রশাসন যদি সংবাদমাধ্যমের পায়ে বেড়ি পরায়, তা হলে আখেরে ক্ষতি সরকারেরই।” তবে ঘটনা হল, মমতা নিজেই সম্প্রতি দলের এক কর্মিসভায় বিশেষ কয়েকটি সংবাদপত্র না-পড়ার ও সংবাদ চ্যানেল না-দেখার নির্দেশ দিয়ে কর্মীদের রীতিমতো শপথ করিয়ে নিয়েছিলেন। তার পরে দলের অন্যান্য নেতা এবং প্রশাসন যে সংবাদমাধ্যমের প্রতি খড়্গহস্ত হবে সেটাই স্বাভাবিক। যদিও রাজ্যের এক মন্ত্রীর বক্তব্য, “এতে আমজনতার কাছে ভুল বার্তা যাচ্ছে। কেন সরকার সাংবাদিকদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে, এখন সেই প্রশ্ন তুলছেন অনেকেই।” সাংবাদিকদের আটকে সরকার কি তা হলে নিজের ভুল-ভ্রান্তি গোপন করতে চাইছে প্রশ্ন প্রশাসনের একাংশের।
প্রশাসনের অনেকের মতে, সাংবাদিকদের গতিবিধির উপরে এত বিধিনিষেধ প্রধানমন্ত্রীর দফতরের মতো দু’-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া দিল্লিতেও নেই। প্রধানমন্ত্রীর দফতরের কোনও অফিসারের সঙ্গে দেখা করতে গেলে আগাম সময় চাইতে হয়। ক্যাবিনেট সচিবালয়, প্রতিরক্ষা বা বিদেশ মন্ত্রকে কারও সঙ্গে দেখা করতে গেলে জনসংযোগ আধিকারিকের অনুমতি নিতে হয়। কিন্তু স্বরাষ্ট্র বা অর্থ মন্ত্রকের মতো গুরুত্বপূর্ণ দফতরেও কারও কাছে যেতে গেলে কেন্দ্রীয় সরকারের দেওয়া সচিত্র পরিচয়পত্রই যথেষ্ট।
অথচ এ রাজ্যে সরকারের নির্দেশিকা অনুযায়ী কোনও সাংবাদিক পুলিশের সবুজ সঙ্কেত ছাড়া নবান্নের কোনও দফতরে পৌঁছতেই পারবেন না। এক পুলিশকর্তার কথায়, “কোনও দফতরে যেতে গেলে সাংবাদিকদের প্রেস কর্নার থেকে সংশ্লিষ্ট অফিসারকে ফোন করতে হবে। তিনি পুলিশ অফিসে ওই সাংবাদিকের নাম বললে তবেই সাক্ষাৎপ্রার্থীকে উপরে ওঠার অনুমতি দেওয়া হবে।”
এহেন নজিরবিহীন নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদে এ দিন সাংবাদিকেরা যা করেছেন তা-ও এক অর্থে নজিরবিহীন। অর্থমন্ত্রীর মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীর সাংবাদিক বৈঠক বয়কট করা হয়েছে এমন ঘটনা মনে করতে পারছেন না প্রশাসনের প্রবীণ অফিসারেরা। তাঁরা বলছেন, বাম আমলে মহাকরণে প্রেস কর্নার ভাঙার পরে সাংবাদিকেরা প্রতিবাদ করেছিলেন। নতুন প্রেস কর্নারে ঢুকতেও অস্বীকার করেছিলেন অনেকে। কিন্তু মন্ত্রীর সাংবাদিক বৈঠক বয়কট করার ঘটনা ঘটেনি।
বিরোধী রাজনীতিকদের অনেকেই বলছেন, মমতা সরকার যে ভাবে সাংবাদিকদের নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছেন, তা অতীতের সব নজির ছাপিয়ে গিয়েছে। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র এ দিন বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী আতঙ্কিত হয়ে সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। এই অগণতান্ত্রিক মনোভাবের বিরুদ্ধে সকলের প্রতিবাদ করা উচিত। সোমবার নবান্নে সাংবাদিকেরা ঠিক কাজই করেছেন।” আর বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যের মতে, “রাজ্যে অঘোষিত জরুরি অবস্থা চলছে।”