আইভিএফে বাড়ছে ‘হেটেরোটপিক’ ঝুঁকি, চিন্তায় চিকিৎসকেরা

বহু বছরের অপেক্ষার পরে সন্তান ধারণ করতে পেরেছিলেন দক্ষিণ কলকাতার আভেরী রায়। কিন্তু ছ’সপ্তাহের মাথাতেই ধরা পড়ল তাঁর গর্ভে দু’টি ভ্রূণ বেড়ে উঠছে। একটি জরায়ুর ভিতরে।

Advertisement

সোমা মুখোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৩ নভেম্বর ২০১৬ ০১:৪০
Share:

বহু বছরের অপেক্ষার পরে সন্তান ধারণ করতে পেরেছিলেন দক্ষিণ কলকাতার আভেরী রায়। কিন্তু ছ’সপ্তাহের মাথাতেই ধরা পড়ল তাঁর গর্ভে দু’টি ভ্রূণ বেড়ে উঠছে। একটি জরায়ুর ভিতরে। অন্যটি জরায়ুর বাইরে, ফ্যালোপিয়ান টিউবে। চিকিৎসার পরিভাষায় যাকে বলে ‘হেটেরোটপিক প্রেগন্যান্সি’। এই ভাবে দু’টি ভ্রূণই বড় হতে থাকলে টিউব ফেটে রক্তক্ষরণ হয়ে মৃত্যুর বড়সড় ঝুঁকি থাকে। আবার বাইরের ভ্রূণটি যদি নষ্ট করার চেষ্টা হয় তা হলে ভিতরের ভ্রূণটিও নষ্ট হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে ষোলো আনা।

Advertisement

এ ক্ষেত্রে চিকিৎসক তা হলে কী করবেন? কোন পথে গেলে মা ও গর্ভস্থ শিশু, উভয়কেই সুস্থ রাখা যাবে?

বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, এ ক্ষেত্রে বেশির ভাগ সময়েই ল্যাপারোস্কোপি করে টিউবের ভ্রূণটি নষ্টের ব্যবস্থা হয়। কিন্তু তাতে অন্য দিকে নানা ঝুঁকি থেকে যায়। যেমন, এই প্রক্রিয়ার ফলে জরায়ুর মধ্যে থাকা ভ্রূণটি ধাক্কা খেতে পারে। অ্যানাস্থেশিয়া প্রয়োগের সময়ে তার জেরেও জরায়ুর ভ্রূণটি নষ্ট হয়ে যেতে পারে। অর্থাৎ, জরায়ুর বাইরের ভ্রূণটিকে মারতে গেলে ভিতরের ভ্রূণটিকে বাঁচানোর আশা বহু ক্ষেত্রেই ছেড়ে দিতে হয়।

Advertisement

বিকল্প আর একটি পদ্ধতিও রয়েছে। কিন্তু ঝুঁকির কারণে তার প্রয়োগ গোটা বিশ্ব জুড়ে খুবই কম। আর তা হল, যোনিপথের মাধ্যমে পটাশিয়াম ক্লোরাইড ইঞ্জেকশন দিয়ে ফ্যালোপিয়ান টিউবের ভ্রূণটিকে নষ্ট করে ফেলা। কিন্তু সে ক্ষেত্রে
ভ্রূণের বয়স আর একটু বেশি হওয়া জরুরি। ছ’সপ্তাহে ভ্রূণের আকার এতটাই ছোট থাকে যে, ঠিক জায়গায় ইঞ্জেকশন দেওয়া বহু ক্ষেত্রেই সম্ভব হয় না। ফলে হেটেরোটপিক প্রেগন্যান্সিতে মা ও শিশু দু’জনকেই সুস্থ রাখা যথেষ্ট বিরল।

আইভিএফ, অর্থাৎ টেস্ট টিউব পদ্ধতিতে অন্তঃসত্ত্বা হওয়া আভেরীদেবী কিন্তু আশা ছাড়তে চাননি। তিনি স্পষ্টই চিকিৎসকদের জানিয়েছিলেন, এত বছরের অপেক্ষার পরে যে সন্তান আসতে চলেছে, তাকে পাওয়ার আশা তিনি এ ভাবে ছেড়ে দিতে পারবেন না। সরাসরি তিনি জানিয়ে দেন, অস্ত্রোপচার করাবেন না। এই পরিস্থিতিতে মাকে সুস্থ অবস্থায় বাঁচিয়ে রাখাই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছিল চিকিৎসকদের কাছে। অনেকেই তাঁকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, এ রাজ্যে চিকিৎসা না করিয়ে ভিন্ রাজ্যে যেতে। কিন্তু কলকাতার চিকিৎসকদের উপরে আস্থা রেখেছিলেন ওই দম্পতি। আর এই শহরের চিকিৎসকেরাও চ্যালেঞ্জটা গ্রহণ করেছিলেন।

ফ্যালোপিয়ান টিউবের ভ্রূণটিকে তাঁরা ইঞ্জেকশনের মাধ্যমেই নষ্ট করার সিদ্ধান্ত নেন। দক্ষিণ কলকাতার এক বেসরকারি কেন্দ্রে চিকিৎসক সুদীপ বসুর তত্ত্বাবধানে গোটা প্রক্রিয়াটি হয়। তিনি বলেন, ‘‘ট্রান্সভ্যাজাইনাল নিডল দিয়ে পটাশিয়াম ক্লোরাইড ইঞ্জেকশন দিয়েছিলাম। ছ’সপ্তাহে ভ্রূণের আকার তখন মাত্র দেড় সেন্টিমিটার। ঠিক সেই জায়গায় ইঞ্জেকশনটি দেওয়া খুবই জটিল এবং সূক্ষ্ম কাজ। অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে এটা আমাদের করতে হয়েছিল। এক চুল এ দিক ও দিক হলেই বড়সড় বিপর্যয় হতে পারত।’’

ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত অবশ্য জরায়ুর বাইরের ভ্রূণটি নষ্ট করে ভিতরের ভ্রূণটি অবিকৃত রাখতে সক্ষম হন তিনি। নিরন্তর তত্ত্বাবধানে বেড়ে উঠতে থাকে জরায়ুর ভ্রূণটি। সম্প্রতি একটি সুস্থ কন্যার জন্ম দিয়েছেন আভেরী।

স্ত্রীরোগ চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, হেটেরোটপিক প্রেগন্যান্সি সাধারণ প্রসবে খুবই বিরল। কিন্তু আইভিএফ পদ্ধতির ক্ষেত্রে এই ঝুঁকি ক্রমশ বাড়ছে। বহু ক্ষেত্রে ধরা পড়ছে কিছুটা দেরিতে। সে ক্ষেত্রে মায়ের ক্ষতির আশঙ্কাও বাড়ছে। আর সেটাই চিকিৎসকদের দুশ্চিন্তার কারণ। স্ত্রীরোগ চিকিৎসক বৈদ্যনাথ চক্রবর্তীর মতে, ফ্যালোপিয়ান টিউবে ভ্রূণ বেড়ে ওঠার অর্থ আগ্নেয়গিরির উপরে বসে থাকা। যে কোনও সময়ে অগ্ন্যুৎপাত হতে পারে। তিনি বলেন, ‘‘সাধারণ ভাবে এ সব ক্ষেত্রে ল্যাপারোস্কোপিই করা হয়। কিন্তু তাতে জরায়ুর ভিতরে থাকা ভ্রূণটিকে বাঁচানোর নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না। তবে মাকে সুরক্ষিত রাখার জন্য এ ছাড়া উপায় থাকে না।’’ স্ত্রীরোগ চিকিৎসক অভিনিবেশ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘এ সব ক্ষেত্রে সাধারণ
ভাবে হয় গোটা টিউবটিই বাদ দেওয়া হয়, নয়তো টিউব ফুটো করে ভ্রূণটি বাদ দিয়ে তার পরে টিউব আবার জোড়া লাগানো হয়। কারণ, ইঞ্জেকশন দিয়ে ভ্রূণ নষ্ট করার ঝুঁকি অনেক। সামান্য এ দিক ও দিক হলে অনেক কিছু ঘটে যেতে পারে। তাই সাধারণ ভাবে এটা সুপারিশ করা হয় না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন