প্রাণঘাতী নয়। কিন্তু জ্বর-পরবর্তী গাঁটের ব্যথায় ভুগতে হচ্ছে মাসের পর মাস। সরকারি হিসেবই বলছে, এক দশক আগে চিকুনগুনিয়ার প্রকোপে লাগাতার শ্রমদিবস নষ্টের দরুন এ দেশে ক্ষতির বহর ছিল বছরে প্রায় ৪০ কোটি টাকা। তবু প্রাণহানি নামমাত্র বলেই ডেঙ্গির তুলনায় অত্যন্ত উপেক্ষিত মশাবাহিত আর এক জ্বর চিকুনগুনিয়া। সেই উপেক্ষার ছাপ পড়ছে রোগ নিরাময়েও। তার চিকিৎসায় খামতি থাকছে বিস্তর।
চিকুনগুনিয়ার জেরে গাঁটের ব্যথার কারণ এবং তার নিরাময়ে ওষুধ তৈরির দিক-নির্দেশ করে গবেষণাপত্র লিখেছেন কলকাতার স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিনের দুই বিজ্ঞানী সুমি মুখোপাধ্যায় ও নীলোৎপল বন্দ্যোপাধ্যায়। তা প্রকাশিত হয়েছে ব্রিটেনের ‘ফ্রি র্যাডিক্যাল রিসার্চ’ এবং জার্মান সংস্থা স্প্রিঙ্গারের ‘ভাইরাস ডিজিজ়’ জার্নালে। প্রাচীন আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় ‘আর্থারাইটিক ফিভার’ বা সন্ধিজ্বরের ব্যথা উপশমে গুলঞ্চলতার রস ব্যবহারের কথা বলা আছে। কলকাতার গবেষকেরাও চিকুনগুনিয়া রোগীদের রক্তকোষে গুলঞ্চলতার রস প্রয়োগ করে আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত পরীক্ষায় সাফল্যের দাবি করছেন। এই গুলঞ্চলতার রসেই ভবিষ্যতে চিকুনগুনিয়ার উন্নত ওষুধ মিলতে পারে বলে জানানো হয়েছে।
পরজীবী বিশেষজ্ঞ তথা চিকিৎসক অমিতাভ নন্দীর কথায়, ‘‘ডেঙ্গি বা চিকুনগুনিয়ার ভাইরাস দমনে কিন্তু কোনও ওষুধই নেই। ভাইরাসের হামলায় যে-ক্ষতি হয়, তার মেরামত আর উপসর্গের মোকাবিলা করাটাই চিকিৎসা।’’ আবার জ্বরজারির ক্ষেত্রে অনেকে রক্তপরীক্ষা করিয়ে যখনই জেনে ফেলেন যে ডেঙ্গি হয়নি, আশ্বস্ত হয়ে হাত গুটিয়ে নেন। চিকুনগুনিয়া হয়েছে কি না, সেই পরীক্ষা আর করান না। কিন্তু এ রোগে জ্বরের দেড়-দু’বছর বাদেও চলতে পারে ব্যথার প্রকোপ। দীর্ঘ অসু্স্থতায় লোকের চাকরি চলে যায়। অনেকেই গভীর অবসাদে ভোগেন। আফ্রিকায় ১৯৫০-এর দশকে রোগটি চিহ্নিত হয়েছিল। এ দেশে ১৯৬৩ নাগাদ তার প্রথম হদিস মেলে কলকাতাতেই। ট্রপিক্যালের গবেষক নীলোৎপলবাবু বলেন, ‘‘ঠাকুরমার ঝুলির হাড়মুড়মুড়ি রোগের বর্ণনার সঙ্গে চিকুনগুনিয়ার লক্ষণের মিল হুবহু। তার থেকেই মনে হয়, বাংলায় এই রোগের বাস দীর্ঘদিনের।’’ ২০০৫ সাল থেকে ফের রোগটির প্রকোপ বেড়েছে।
মহাগুণবতী লতা
গুলঞ্চলতার বৈজ্ঞানিক নাম ‘ইন্ডিয়ান টিনোস্পোরা’। অথর্ব বেদ জানাচ্ছে, গুলঞ্চরস হল অমৃত। চরক-সুশ্রুত বলছেন, বিষম জ্বর, জন্ডিস, বাতরক্ত প্রভৃতির নিরাময় আছে গুলঞ্চে। আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য লিখেছেন, বাতের যন্ত্রণা, বাতরক্তে গুলঞ্চের ক্বাথ বিশেষ উপযোগী।
চিকুনগুনিয়ার ব্যথার কারণ এবং তার ওষুধ খুঁজতে সুমিদেবী-নীলোৎপলবাবু গত তিন বছরে শ’দুয়েক রোগীর অবস্থা খতিয়ে দেখেন। রাজ্য সরকারের জৈবপ্রযুক্তি দফতরের অর্থানুকূল্যে চলে গবেষণা। দু’টি গবেষণাপত্রে ৬৭ জন চিকুনগুনিয়া রোগীর নথি সঙ্কলিত হয়েছে। প্রথম বিশ্বের দেশগুলিতে রোগটির প্রকোপ কম বলে সেখানকার গবেষণা কেন্দ্রে এই নিয়ে এত দিন তেমন কোনও কাজ হয়নি। নীলোৎপলবাবুরা ভাইরাস-আক্রান্ত কোষগুলির উপরে গবেষণা চালিয়ে সংক্রমণের জেরে কয়েকটি প্রোটিনের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছেন। চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ কতটা তীব্র, তা জরিপ করতে এই প্রোটিনগুলি এক ধরনের ‘বায়োমার্কার’-এর ভূমিকা নেয়।
এর পরে প্রাচীন চিকিৎসাশাস্ত্র ঘাঁটতে ঘাঁটতে গুলঞ্চের বিষয়টি মাথায় আসে। ‘‘বাংলাদেশের মানিকগঞ্জে বেড়াতে গিয়েও দেখি, জ্বরের গাঁটের ব্যথায় কবিরাজেরা গুলঞ্চলতার রস কাজে লাগাচ্ছেন। আমাদের নিরীক্ষাতেও এর উপযোগিতা প্রমাণিত,’’ বললেন নীলোৎপলবাবু। ভবিষ্যতে গুলঞ্চলতা নিয়ে আরও গবেষণার ইচ্ছে আছে এই দুই বিজ্ঞানীর।