সহকর্মীর মৃত্যুতে চিন্তায় আরপিএফ জওয়ানেরা

হাসিখুশি স্বভাবের সমরেশ সামন্ত (৩৫) যে আর বেঁচে নেই, তা তাঁর প্রতিবেশীরাও আর ভাবতে পারছেন না। সোমবার মালদহ রেল স্টেশনে লাইসেন্সহীন হকারদের সঙ্গে আরপিএফের সংঘর্ষের সময় প্রাণ গিয়েছে সমরেশবাবুর। তিনিও আরপিএফের কনস্টেবল। এ দিন সকালে হকারদের সঙ্গে গোলমালের সময় তিনি অবশ্য ব্যারাকেই ছিলেন। বাইরে চিৎকার চেঁচামেচি শুনে ব্যারাকের ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ২৬ মে ২০১৫ ০৩:৫৬
Share:

আরপিএফ ব্যারাকে ভাঙচুর মালদহে

হাসিখুশি স্বভাবের সমরেশ সামন্ত (৩৫) যে আর বেঁচে নেই, তা তাঁর প্রতিবেশীরাও আর ভাবতে পারছেন না। সোমবার মালদহ রেল স্টেশনে লাইসেন্সহীন হকারদের সঙ্গে আরপিএফের সংঘর্ষের সময় প্রাণ গিয়েছে সমরেশবাবুর। তিনিও আরপিএফের কনস্টেবল। এ দিন সকালে হকারদের সঙ্গে গোলমালের সময় তিনি অবশ্য ব্যারাকেই ছিলেন। বাইরে চিৎকার চেঁচামেচি শুনে ব্যারাকের ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। তখনই বাইরে থেকে উড়ে এসে একটি ইট গিয়ে পড়ে তাঁর মাথায়। মাথা ফেটে যায়। ঘটনাস্থলেই মারা যান সমরেশবাবু।
ঘটনার পরে আরপিএফ ব্যারাকের অন্যান্য জওয়ানদের চোখে মুখে এখন আতঙ্কের ছাপ। এক আরপিএফ জওয়ান বলেন, ‘‘চোখের সামনে তাঁকে মারা যেতে দেখলাম। আমরা ঘর থেকে বার হচ্ছি তখনই দেখি একটি আধখানা ইট সমরেশবাবুর মাথায় পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি মারা যান। তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় পাওয়া যায়নি। আমরা সবাই আতঙ্কে রয়েছি।’’

Advertisement

সমরেশবাবুর বাড়ি কাছেই উত্তর দিনাজপুরের রায়গঞ্জে। সমরেশবাবুর স্ত্রী পম্পাদেবী তাঁর তিন বছরের মেয়ে নম্রতাকে নিয়ে রায়গঞ্জের নেতাজিপল্লি এলাকার একটি আবাসনে থাকেন। স্বামীর মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর তিনি মেয়েকে নিয়ে রায়গঞ্জের সুভাষগঞ্জ এলাকার বাপের বাড়িতে চলে গিয়েছেন।

পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রায় ৯ বছর আগে সমরেশবাবু আরপিএফে চাকরি পান। ৪ বছর আগে সুভাষগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা পম্পাদেবীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। সমরেশবাবুর এক ভাই কলকাতায় থাকেন। তাঁর বাবা অবসরপ্রাপ্ত রেলকর্মী। তাঁর বাবা-মা থাকেন শিলিগুড়িমোড় এলাকার একটি আবাসনে। বর্তমানে তাঁরা সকলেই কলকাতায় রয়েছেন। ছেলের মৃত্যুর খবর পেয়ে তাঁরা এদিনই কলকাতা থেকে রায়গঞ্জে রওনা হয়েছেন বলে জানা গিয়েছে।

Advertisement

পম্পাদেবীর জ্যাঠতুতো দাদা সুকান্ত সরকার বলেন, ‘‘সমরেশ নিজের সরকারি দায়িত্ব পালন সম্পর্কে সব সময়েই সচেতন থাকতেন। বিনা কাজে ছুটি নিয়ে তিনি বাড়িতে আসতেন না। এখন বোন ও ভাগ্নির কী হবে, আমরা সেই চিন্তায় রয়েছি।’’ এদিন সন্ধ্যায় সমরেশবাবুর মৃতদেহ আনার জন্য মালদহের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছেন সুকান্তবাবু সহ তাঁর শ্বশুর বাড়ির লোকজনেরা।

রায়গঞ্জের নেতাজিপল্লি এলাকার বাসিন্দা সমরেশবাবুর প্রতিবেশী কৃষ্ণ সরকার ও উত্পল ঘোষ জানান, সমরেশবাবু খুব হাসিখুশি ও নিরীহ স্বভাবের ছিলেন। তিনি কোনওদিনও কারোর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেননি। এত ভাল মানুষ এ ভাবে চলে গেলেন, তা তাঁরা ভাবতে পারছেন না।

উল্টো দিকে, মালদহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ঝাটন দাস বলছেন, ‘‘সংসারের কথা ভেবে মরিয়া হয়েই এ দিন স্টেশনে ব্যবসা করতে গিয়েছিলাম।’’ তাঁর বৌদি জানান, জানুয়ারি থেকেই মালদহে লাইসেন্সহীন হকারদের আরপিএফ উচ্ছেদ করে দেয়। তখন থেকে ঝাটন নানা রকমের কাজেরই চেষ্টা করেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত স্টেশনে রুটি সব্জি বিক্রি করার পেশাতেই ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন। ঝাটন বলেন, ‘‘অনেক দিন থেকেই স্টেশনে রুটি সব্জি বিক্রি করছি। এটাই আমার পেশা। এখন আচমকা অন্য কোনও কাজ কী ভাবে করব? তাই বারবার রেল কর্তৃপক্ষকে আমরা স্মারকলিপি দিয়ে আমাদের আবার ব্যবসা করার সুযোগ দিতে অনুরোধ করছিলাম। কিন্তু তাঁরা মুখে আশ্বাস দিলেও কাজের কাজ কিছু করেননি।’’ এ দিন বাধ্য হয়েই স্টেশনে বসতে গেলে আরপিএফ কর্মীরা তাঁকে মারধর করেন। ঝাটনবাবুর মাথা ফেটে গিয়েছে। তাঁকে মারধরের খবর ছড়িয়ে পড়তেই স্টেশন চত্বর আস্তে আস্তে রণক্ষেত্র হয়ে ওঠে। তাতেই মারা যান সমরেশবাবু।

সোমবার মালদহ টাউন স্টেশন চত্বরে সংঘর্ষ আরপিএফ ও হকারদের। আরপিএফ জওয়ান

আর কে শাহকে ঘিরে ধরে মারছেন হকারেরা। সোমবার তোলা নিজস্ব চিত্র।

এলাকার বাসিন্দাদের বক্তব্য, চার মাস ধরে লাইসেন্সহীন হকারদের সঙ্গে রেল কর্তৃপক্ষের এই বিবাদ চলছে। সে কথা রাজনৈতিক দলের নেতারাও জানেন। তবু তাঁরকা কেন তা মেটাতে ব্যবস্থা নেননি? রাজ্যের মন্ত্রী কৃষ্ণেন্দুনারায়ণ চৌধুরী বলেন, ‘‘এদিনের ঘটনাটি খুবই দুঃখজনক। আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি মেটানো উচিত ছিল। পুলিশ পুলিশের কাজ করবে।’’ এই ঘটনার জন্য রেল কর্তৃপক্ষকে দায়ী করেছেন কংগ্রেসের জেলা সভানেত্রী মৌসম নুর। তিনি বলেন, ‘‘হকারেরা চার মাস ধরে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁরা স্মারকলিপিও দিয়েছেন বেশ কয়েকবার। তবুও রেল কর্তৃপক্ষ কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। তবে এদিনের ঘটনাকে আমরা সমর্থন করি না। আলোচনায় মেটানো উচিত ছিল।’’

ভারতীয় মজদুর ইউনিয়নের সংঘের সম্পাদক সুবল দাস বলেন, ‘‘হকারদের প্ল্যাটফর্মে ব্যবসা করতে দেওয়া হচ্ছে না। এদিন আমাদের সংগঠনের এক হকারকে ধরে মারধর করেছে আরপিএফ। অভিযোগ জানাতে গেলে অভিযোগ নেয়নি। এমনকি আমাদের মারধর করেছে। আমাদের হকারের কোনও ভাঙচুর করেনি।’’ আরপিএফের কমান্ড্যান্ট এস এস তিওয়ারি বলেন, ‘‘আমাদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ ভিত্তিহীন। আমাদের এক কর্মী খুন হয়েছে। এক কর্মীকে মারধর করেছে। আমরা মামলা রুজু করেছি। অভিযুক্তদের চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে।’’ মালদহের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার অভিষেক মোদি বলেন, ‘‘পুলিশ পিকেট বসানো হয়েছে। এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন