মঙ্গলবার মমতার সঙ্গে কথা সব্যসাচীর। পাশেই কৃষ্ণা চক্রবর্তী। —নিজস্ব চিত্র।
কিসমত কা খেল আর কাকে বলে!
কিছু দিন আগেও শাসক দলের অন্দরে তাঁর পরিচিতি ছিল ‘মুকুল রায়ের লোক’! দলেরই একাংশ সন্দেহের চোখে দেখত তাঁকে। আর তিনিও নানা রহস্যময় মন্তব্য করে ধাঁধাঁ জমিয়ে তুলছিলেন। ঘটনার মোচড়ে এ বার সেই সব্যসাচী দত্তের হাতেই শারদ উপহারের মতো এসে পড়ল বিধাননগর পুর-নিগমের মেয়র পদ! কৃষ্ণা চক্রবর্তী, তাপস চট্টোপাধ্যায় বা বাণীব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়দের নাম নিয়ে নানা জল্পনায় ইতি টেনে মঙ্গলবার তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিধাননগরের নতুন মেয়র হিসাবে রাজারহাট-নিউটাউনের বিধায়ক সব্যসাচীর নামই ঘোষণা করে দিলেন। দলের এক সাংসদ বা ‘ওজনদার’ বিধায়কের আপত্তি উড়িয়েই!
বিধানসভা ভোটের আগে দলনেত্রীর আস্থা অর্জন করে হবু মেয়রও বিধাননগরে দলের ভাবমূর্তি উদ্ধারে কৌশলী পদক্ষেপ শুরু করেছেন। সব্যসাচী জানিয়েছেন, ভোটের সময় যে গোলমাল হয়েছে, শপথের পরে বিধাননগরের মানুষের কাছে তার জন্য তিনি দুঃখপ্রকাশ করবেন। পাশাপাশি আরও বলেছেন, ‘‘শপথের পরে আমাকে বাদ দিয়ে ৪০ জন কাউন্সিলরই আমার। সেখানে তৃণমূল, সিপিএম, কংগ্রেস বলে কেউ নেই! সকলে কাজ করতে হবে।’’ রাজ্য রাজনীতির হালফিলের ইতিহাস ঘাঁটলে তৃণমূলের কোনও পদাধিকারীর মুখে এমন মন্তব্য বিরল বলেই ধরতে হবে!
সব্যসাচীকে মেয়র-পদে তুলে আনার পাশাপাশিই মমতা অবশ্য চেষ্টা করেছেন বিধানসভা ভোটের আগে দলে গোষ্ঠী-দ্বন্দ্বের কথা মাথায় রেখে যথাসম্ভব ভারসাম্য রাখার। বিধাননগর ও আসানসোল, দুই পুর-নিগমেই এই সূত্র মেনে এগোনোর চেষ্টা করেছেন তিনি। ক্ষুদিরাম অনুশীলন কেন্দ্রে এ দিন বিধাননগর, আসানসোল ও বালির নবনির্বাচিত কাউন্সিলরদের নিয়ে বৈঠকে মমতা জানিয়েছেন, বিধাননগরের ডেপুটি মেয়র হবেন রাজারহাটের তাপস চট্টোপাধ্যায়। পুরনো বিধাননগর পুরসভার বিদায়ী চেয়ারপার্সন কৃষ্ণা নতুন পুর-নিগমের চেয়ারপার্সন হচ্ছেন। আসানসোলে মেয়র বদল হচ্ছে। বিধায়ক তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিবর্তে নতুন পুর-নিগমের মেয়র হচ্ছেন জিতেন্দ্র তিওয়ারি। একই সঙ্গে হিন্দিভাষী ভোটব্যাঙ্ককে বার্তা দেওয়া এবং অন্য দিকে গোষ্ঠী-দ্বন্দ্ব সামলাতে জিতেন্দ্রকেই মেয়র বেছেছেন মমতা। বিগত বোর্ডে আসানসোলের চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য যুক্তি দিয়েছেন, আগামী বছর বিধানসভা ভোটে তাপসবাবুকে ব্যস্ত থাকতে হবে। সেই কারণেই তাপসবাবুকে মেয়রের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হল। মহিলা এবং সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধি হিসাবে নবাগতা তবস্সুম আরাকে ডেপুটি মেয়র করা হচ্ছে। চেয়ারম্যান হচ্ছেন অমরনাথ চট্টোপাধ্যায়।
সব্যসাচী, কৃষ্ণা, তাপস না এঁদের বাইরে বাণীব্রতের মতো কোনও চমক— কে মেয়র হবেন, তা নিয়ে বিধাননগরের নানা গোষ্ঠীর নানা চাপ ছিল। শেষ পর্যন্ত এ দিনের সভায় মমতা বলেছেন, অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার নিরিখেই তিনি সব্যসাচীকে মেয়র করছেন। তৃণমূল নেতৃত্বের ব্যাখ্যা, সল্টলেকের সঙ্গে পুরনো রাজারহাট জুড়ে এখন নতুন পুর-নিগম তৈরি হয়েছে। সেখানে এমন কাউকেই মেয়র হিসাবে দরকার, যাঁর দুই এলাকাতেই পরিচিতি আছে। সল্টলেকের কাউন্সিলর এবং নিউটাউনের বিধায়ক হিসাবে এই চাহিদা সব্যসাচীই পূরণ করছেন। ভোটের দিন তাঁর ওয়ার্ডে বিশেষ গোলমালের অভিযোগ ওঠেনি। বিধাননগর ও নিউটাউনে নানা অংশের মানুষের সঙ্গেই ব্যক্তি সব্যসাচীর সম্পর্ক ভাল। এ বার পুরভোটের আগে মূলত তাঁর উদ্যোগেই মারোয়াড়ি সমাজ তৃণমূলকে সমর্থন দিয়েছিল। ভোটের দিন শাসক দলের গা-জোয়ারি দেখে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দিলেও মারোয়াড়ি সম্প্রদায়ের পক্ষে ব্যবসায়ী কমল গাঁধী এ দিন মন্তব্য করেছেন, সব্যসাচী মেয়র হওয়ায় তাঁরা খুশি।
তবে এ সবের বাইরে অন্য ব্যাখ্যাও আছে। দলেরই একাংশ বলছে, মেয়র-পদ না হলে ভবিষ্যতে কারা দলের জন্য বেশি সমস্যা তৈরি করতে পারেন, তা মেপে নিয়েছেন মমতা। এবং বুঝেশুনেই সব্যসাচীকে মেয়র করে তিনি বিধানসভা ভোটের আগে নিউটাউনের বিধায়কের হাত-পা বেঁধে দিয়েছেন! পাশাপাশিই সারদা-কাণ্ডে কৃষ্ণা ও তাঁর পরিবারের নাম জড়ানো তাঁর বিরুদ্ধে গিয়েছে। আর সদ্য সিপিএম থেকে আসা তাপসকে তৃণমূল নেত্রী এক লাফে মেয়র করতে চাননি। কিন্তু ওই দু’জন যাতে ক্ষুব্ধ হয়ে না ওঠেন, সেই চেষ্টাও এ দিন করতে হয়েছে মমতাকে। ক্ষুদিরাম অনুশীলন কেন্দ্রে তিন পুর-এলাকার নতুন কাউন্সিলরদের সঙ্গে বৈঠকে মমতা এ দিন নির্দেশ দিয়েছেন, ‘‘সব্যসাচী, তাপস এবং কৃষ্ণা তিন জনেরই অভিজ্ঞতা রয়েছে। আরও উন্নয়ন এবং মানুষের পাশে থেকে তাদের জন্য কাজ করতে হবে।’’ মঞ্চে এক দিকে সব্যসাচী ও অন্য দিকে কৃষ্ণাকে নিয়ে তৃণমূল নেত্রী বলেছেন, ‘‘কৃষ্ণা দীর্ঘদিন বিধাননগরে ভাল কাজ করেছে। অভিজ্ঞতাও রয়েছে। তাই ওঁকে চেয়ারপার্সনের ম্যানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।’’ আগামী বিধানসভা ভোটে কৃষ্ণাকে বড় কোনও দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে বলেও শাসক দলের নেতৃত্বের একাংশের ধারণা।
তবে সব্যসাচীর মেয়র পদপ্রাপ্তির পরে শাসক দলের একাংশ প্রশ্ন তুলতেও ছাড়ছে না। দলের এক নেতার কথায়, ‘‘দলনেত্রী বলতেন, সিন্ডিকেট করলে এই দলটা করা যাবে না। মেয়র ঘোষণার পরে আর ওই কথা বলার মুখ থাকবে তো আমাদের?’’ প্রসঙ্গত, নিউটাউন, সল্টলেক ও সংলগ্ন এলাকায় সিন্ডিকেট-রাজ নিয়ে একাধিক বার বিবাদে জড়িয়েছেন সব্যসাচী ও বিধাননগরের বিধায়ক সুজিত বসু।
সব্যসাচী অবশ্য এখন এ সব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন না। তাঁর বক্তব্য, মেয়র হওয়ার পরে তিনি বিধাননগরের বাসিন্দাদের প্রথম দিতে চান মিষ্টি পানীয় জল। চান কলকাতা পুরসভার মতো পরিষেবা দিতে। তিনি বিলক্ষণ এটাও জানেন যে, গা-জোয়ারির ভোটের পরে বীতশ্রদ্ধ বিধাননগরের বাসিন্দাদের অনেকে নতুন কাউন্সিলরদের সামাজিক স্বীকৃতিই দিতে চাইছেন না। তাই দুঃখপ্রকাশ করে তাঁদের ভাবাবেগ সামাল দেওয়ার কথাও বলতে হচ্ছে তাঁকে। এখনও পর্যন্ত যা ঠিক আছে, আগামী ১৬ অক্টোবর বিধাননগর পুরভবনের সামনে অথবা এফডি ব্লকের মাঠে মেয়র, ডেপুটি মেয়রদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান হতে পারে।
আসানসোলের হবু মেয়রের কাছে অবশ্য এ দিনটা অপ্রত্যাশিতই ছিল। দলনেত্রীর মুখে আসানসোলের মেয়র হিসাবে নিজের নাম ঘোষণা শুনে জিতেন্দ্র বলেন, ‘‘ভাবিইনি মেয়র হব! চেষ্টা করব খুব ভাল ভাবে কাজ করার।’’ আসানসোলে বিদায়ী মেয়র তাপসবাবুর পাশাপাশি মেয়র পদপ্রার্থী হিসাবে দলের মধ্যে গুঞ্জন ছিল শ্রমমন্ত্রী মলয় ঘটকের ভাই অভিজিৎকে নিয়েও। তৃণমূলের এক শীর্ষ নেতার বক্তব্য, শেষ পর্যন্ত জিতেন্দ্র এবং ডেপুটি হিসাবে তবস্সুমের মতো নতুন মুখকে দায়িত্ব দিয়ে তৃণমূল নেত্রী মলয়, তাপসবাবুদের বুঝিয়ে দিলেন, গোষ্ঠী-দ্বন্দ্ব তিনি বরদাস্ত করবেন না।
বালির পুর-এলাকা হাওড়া পুরসভার সঙ্গে জুড়ে গিয়েছে। হাওড়ার মেয়র রথীন চক্রবর্তীকে বালি, দক্ষিণেশ্বরের প্রতি বিশেষ নজর দিতে নির্দেশ দিয়েছেন মমতা। নতুন মেয়র, ডেপুটি মেয়র বা চেয়ারম্যানদের কী ভাবে কাজ করতে হবে, তা বুঝিয়ে দিতে ফিরহাদ হাকিম, অরূপ বিশ্বাস এবং শোভন চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে এ দিন একটি কমিটিও গড়ে দিয়েছেন মমতা।