আজব দলিলের কলম-কাণ্ড

নেহাতই ছোট একটি সাপ্তাহিক সংবাদপত্র। যার বিক্রিবাটা না থাকায় কর্মীদের মাইনেও কার্যত বন্ধ বলে অভিযোগ। সম্পদ বলতে দু’টি ডেস্কটপ কম্পিউটার এবং কিছু চেয়ার-টেবিল। এমনই একটি কাগজ তিনি বেশ কয়েক কোটি টাকায় কিনেছিলেন বলে গোয়েন্দাদের কাছে দাবি করেছেন সারদা-কর্তা সুদীপ্ত সেন! কোন জাদুবলে এত টাকায় বিক্রি হয়েছিল ‘কলম’ পত্রিকা, জানতে তদন্তে নেমেছে ইডি।

Advertisement

শুভাশিস ঘটক

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ ডিসেম্বর ২০১৪ ০৩:৪৩
Share:

দৈনিক ‘কলম’ পত্রিকার সূচনা করছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সঙ্গে তৃণমূল সাংসদ শতাব্দী রায়, সুলতান আহমেদ ও মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। ৫ এপ্রিল, ২০১২। — ফাইল চিত্র।

নেহাতই ছোট একটি সাপ্তাহিক সংবাদপত্র। যার বিক্রিবাটা না থাকায় কর্মীদের মাইনেও কার্যত বন্ধ বলে অভিযোগ। সম্পদ বলতে দু’টি ডেস্কটপ কম্পিউটার এবং কিছু চেয়ার-টেবিল। এমনই একটি কাগজ তিনি বেশ কয়েক কোটি টাকায় কিনেছিলেন বলে গোয়েন্দাদের কাছে দাবি করেছেন সারদা-কর্তা সুদীপ্ত সেন!

Advertisement

কোন জাদুবলে এত টাকায় বিক্রি হয়েছিল ‘কলম’ পত্রিকা, জানতে তদন্তে নেমেছে ইডি। পত্রিকাটি সুদীপ্তকে বিক্রি করেছিলেন আহমেদ হাসান ইমরান। যিনি বর্তমানে তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ। কিন্তু ইডি-র তদন্তকারীদের দাবি, বিক্রিবাটার যে দলিল ইমরান তাঁদের কাছে জমা দিয়েছেন, সেটি জাল। এ ব্যাপারে আনন্দবাজারের তরফে ইমরানকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “আমি কোনও বিষয়ে কোনও কথা বলব না।”

ইমরানকে ইতিমধ্যেই দু’বার জেরা করেছে ইডি। সূত্রের খবর, জেরায় ইডি-র অফিসারদের ইমরান দাবি করেছেন, কত টাকায় তিনি সারদাকে ‘কলম’ বিক্রি করেছিলেন, তা তাঁর মনে নেই। দলিলটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল ২০১১ সালের ২০ জুলাই। ইডি-র কাছে সুদীপ্ত সেনের অভিযোগ, কোটি কোটি টাকা ঢালার পরেও শেষ পর্যন্ত ‘কলম’ পত্রিকার মালিকানা হাতবদল করে তাঁকে দেওয়া হয়নি।

Advertisement

সারদার কাছে বিক্রি করার আগে ‘কলম’ প্রকাশ করত ইমরানের সংস্থা দেশকাল পাবলিকেশন। চিত্রশিল্পী শুভাপ্রসন্নর মালিকানাধীন দেবকৃপা ব্যাপার প্রাইভেট লিমিটেড-এর টিভি চ্যানেল ‘এখন সময়’-এর বিক্রিবাটা নিয়ে যেমন তদন্তকারীদের নানা প্রশ্ন রয়েছে, তেমনই প্রশ্ন রয়েছে ইমরানের ‘কলম’ পত্রিকা নিয়েও। দেশকাল পাবলিকেশন-এর সঙ্গে সুদীপ্ত সেনের ঠিক কী বোঝাপড়া হয়েছিল, ইমরান কত টাকা পেয়েছিলেন, সে টাকা কোথায় গেল এই সব জানতে প্রথম বার জেরার পরেই ইমরানের কাছে ‘কলম’ বিক্রি সংক্রান্ত আইনি কাগজপত্র চাওয়া হয়েছিল। দ্বিতীয় বার ইডি-র কাছে হাজিরা দিয়ে তৃণমূল সাংসদ সেই কাগজপত্র জমা দেন। কিন্তু ইডি সূত্রের দাবি, স্ট্যাম্প পেপারে সুদীপ্ত সেন ও ইমরানের সই করা সেই দলিলে সর্বত্রই টাকার অঙ্কটি ফাঁকা রাখা হয়েছে! ইডি-র তদন্তকারীদের অভিযোগ, ইমরান তাদের যে নথি দিয়েছেন, তাতে সাক্ষীর সইটিও জাল!

তদন্তকারীদের অভিযোগ, ২০১১ সালে ‘কলম’ পত্রিকার বিক্রিবাটায় মধ্যস্থ ছিলেন তৃণমূলের এক শীর্ষস্থানীয় নেতা। নতুন করে ওই সংবাদপত্র যখন দৈনিক আকারে প্রকাশিত হয়, সে দিন দলের বেশ কয়েক জন মন্ত্রী-সাংসদকে নিয়ে হাজির ছিলেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ইডি-র পাশাপাশি সিবিআই-ও ‘কলম’ বিক্রি নিয়ে ইমরানের কাছে তথ্য চেয়েছিল। নিজে না-গিয়ে আইনজীবীর মাধ্যমে ইমরান কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার কাছে সেই তথ্য পাঠিয়েছেন। সূত্রের খবর, সেই তথ্যেও নানা অসঙ্গতি দেখে সিবিআই এ বার সশরীর হাজির হওয়ার জন্য ইমরানকে নোটিস পাঠিয়েছে।

তৃণমূল সাংসদ এই ইমরানের বিরুদ্ধেই জঙ্গি-যোগের অভিযোগও রয়েছে। কী রকম? ইমরান স্টুডেন্ট ইসলামিক ফ্রন্ট অব ইন্ডিয়ার (সিমি) প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন। পরে জঙ্গি কার্যকলাপের অভিযোগে এই সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করা হয়। ইমরান আরবের ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্কের ভারতীয় এজেন্ট। এই ব্যাঙ্কটির বিরুদ্ধেও সন্দেহজনক কাজকর্মে মদত দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। বাংলাদেশের মৌলবাদী শক্তি জামাতে ইসলামির সঙ্গেও ইমরানের যোগাযোগ রয়েছে বলে অভিযোগ। বস্তুত, ইমরান তৃণমূলের টিকিটে রাজ্যসভায় যাওয়ার পরে বাংলাদেশ সরকারই জামাতের সঙ্গে ইমরানের যোগাযোগের কথা জানিয়ে দিল্লির কাছে কূটনৈতিক ডসিয়ের পাঠিয়েছিল। এমনকী, তারও আগে প্রার্থী হিসেবে ইমরানের নাম ঘোষণার পরেই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব অনিল গোস্বামী নিজে নবান্নে এসে ইমরানের জঙ্গি-যোগ নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে অবহিত করে গিয়েছিলেন। কেন্দ্রীয় আর রাজ্য সরকারের গোয়েন্দারাও দীর্ঘদিন ধরে ইমরানকে সন্দেহভাজনের তালিকায় রেখেছেন।

আর সে জন্যই ‘কলম’ বেচে পাওয়া কোটি কোটি টাকার কী গতি হয়েছে, সেটা জানতে উঠেপড়ে লেগেছেন তদন্তকারীরা। সম্প্রতি বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ কলকাতায় এসে প্রকাশ্য সভায় অভিযোগ করে গিয়েছেন, সারদার টাকা খাগড়াগড় বিস্ফোরণে কাজে লেগেছে। তারও আগে জেলবন্দি সাসপেন্ডেড তৃণমূল সাংসদ কুণাল ঘোষ অভিযোগ করেন, সারদার কোটি কোটি টাকা অ্যাম্বুল্যান্সে করে বাংলাদেশের জঙ্গিগোষ্ঠী-জামাতের হাতে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। আর সে কাজ করেছেন এই ইমরানই।

কত টাকায় হাতবদল হয়েছিল ‘কলম’ পত্রিকা?

শ্যামল সেন কমিশন ও ইডি-কে সারদা-কর্তা সুদীপ্ত সেন জানিয়েছেন, কার্যত কোনও সম্পদ না থাকা সত্ত্বেও পত্রিকাটি কেনার জন্য প্রথমে সাড়ে চার কোটি টাকা দিতে বলা হয়েছিল তাঁকে। কিন্তু তার পর আরও চাপ দিয়ে কয়েক দফায় তাঁর কাছ থেকে ইমরান ও ‘অন্যরা’ ১৬ থেকে ১৮ কোটি টাকা নিয়েছিলেন বলে সুদীপ্তর অভিযোগ।

সারদার এক ম্যানেজার রাজ্য সরকারের তৈরি শ্যামল সেন কমিশনকে লিখিত ভাবে জানিয়েছিলেন, ‘কলম’ পত্রিকা কেনার জন্য তিন দফায় ১৫ কোটি টাকা দিতে হয়েছিল। এ ছাড়াও পত্রিকাটি দৈনিক আকারে প্রকাশ করার জন্য ৮২টি কম্পিউটার, দু’টি শক্তিশালী সার্ভার, ৬-৭টি দামী ল্যাপটপ ও বেশ কয়েকটি অত্যাধুনিক ক্যামেরা কেনানো হয়। অভিযোগ, বেশ কয়েকটি ল্যাপটপ শেষ পর্যন্ত আর অফিসে আসেনি, ক্যামেরাগুলিও আসার ক’দিন পরেই উধাও হয়ে যায় বলে অভিযোগ।

সারদা টাকা ঢালার পরে ‘কলম’ দৈনিক আকারে প্রকাশিত হয় ২০১২ সালের ৫ এপ্রিল। টাউন হলের সেই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়, মুকুল রায়, সুলতান আহমেদ, শতাব্দী রায়, কুণাল ঘোষ, ত্বহা সিদ্দিকিরা। আর অনুষ্ঠানের মধ্যমণি ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তৃণমূল নেত্রী সেই অনুষ্ঠানে বলেন, “রাজ্যের সংখ্যালঘুদের কাছে মা-মাটি-মানুষের খবর পৌঁছে দেওয়ার জন্যই এই দৈনিকটির জন্ম হল।” এ জন্য তিনি সারদা মিডিয়ার ভূয়সী প্রশংসা করেন। সাধুবাদ দেন ইমরানকেও।

‘কলম’ পত্রিকায় ‘সারদা’র লোগো ছাড়া সম্পাদক হিসেবে সুদীপ্ত সেনের নাম ছাপা হতে থাকে। আর ইমরানের নাম থাকে কার্যকরী সম্পাদক হিসেবে। অভিযোগ, শুরুতে তিনি মাসে ৫০ হাজার টাকা বেতন ছাড়া অন্যান্য খাতে বহু টাকা ও সুযোগ সুবিধা পেতেন, যা তাঁর পে-স্লিপে লেখা থাকত না। কয়েক মাস পরে সেই বেতন বেড়ে ৭৫ হাজার হয়। কিন্তু ছুতোনাতায় সংস্থা থেকে টাকাকড়ি নেওয়া এতটাই বেড়ে যায়, সুদীপ্তও বিরক্ত হয়ে পড়েন। সারদার ওই ম্যানেজার শ্যামল সেন কমিশনের কাছে দাবি করেছেন মেজাজ হারিয়ে সুদীপ্ত এক দিন প্রকাশ্যেই ইমরানকে বলেন, “আপনি বাড়িতে থেকেই মাইনে নিন। দয়া করে অফিসে এসে আর টাকার বায়না করবেন না!”

সিবিআই সূত্রের খবর, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের কাছে তাঁর বয়ানেও সুদীপ্ত আক্ষেপ করে বলেছেন, মিডিয়ার ব্যবসাই তাঁকে পথে বসিয়েছে। অর্থাৎ ‘কলম’-এর খোঁচা বিলক্ষণ টের পেয়েছিলেন তিনি!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন