পঞ্চমীর দুপুর ছিল সে দিন। সালটা ২০১৪। সিবিআই আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে তৃণমূলের সাসপেন্ডেড সাংসদ প্রবল হতাশায় বলেছিলেন, ‘‘যাঁরা সারদার থেকে সুবিধে নিয়েছেন, তাঁরা বাইরে পুজোর উদ্বোধন করে বেড়াচ্ছেন। আর আমি জেলে বসে ঢাকের আওয়াজ শুনব, এটা হতে পারে না।’’
২০১৬-র চতুর্থীতে সেই তিনিই জেলের বাইরে বসে ঢাকের আওয়াজ শোনার ছাড়পত্র পেলেন। সিবিআইয়ের দায়ের করা সারদা ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস সংক্রান্ত একটি মামলাতেই জামিন পাওয়া বাকি ছিল কুণাল ঘোষের। সেই মামলায় বুধবার তাঁকে ১১ নভেম্বর পর্যন্ত শর্তসাপেক্ষে অন্তর্বর্তিকালীন জামিন দিল কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ।
সম্প্রতি নিম্ন আদালতে জামিন পেয়েছেন সারদা মামলার আর এক অভিযুক্ত, প্রাক্তন মন্ত্রী মদন মিত্র। কুণাল জামিন পেলেন গ্রেফতার হওয়ার ৩৪ মাস ১৩ দিন পর। মদনের জামিনের পরে তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছে দল। কিন্তু কুণাল খাতায়-কলমে এখনও তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ হলেও তাঁর জামিন নিয়ে সারা দিনে দলের এক জন নেতাও প্রকাশ্যে মুখ খোলেননি। যা দেখে অনেকের মত, কুণাল সম্পর্কে দলনেত্রীর বর্তমান অবস্থান জানার আগে এ নিয়ে ঝুঁকি নিতে চাইছেন না কেউই। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তৃণমূলের এক শীর্ষ নেতা অবশ্য বলেছেন, ‘‘ভাল খবর। অনেক দিন জেলে কষ্ট পেয়েছেন কুণাল।’’ আর কতকটা কুণালের সুরেই বিরোধী দলনেতা আব্দুল মান্নানের প্রতিক্রিয়া, ‘‘সারদা-কাণ্ডের রাঘব বোয়ালরা রোজ পুজোর ফিতে কেটে বেড়াচ্ছেন। সেখানে মদন বা কুণালরা জেলে থাকলে তা তো হাস্যকরই! ’’
কুণাল যে জামিন পেতে পারেন, সেই ইঙ্গিত মঙ্গলবারই দিয়েছিল হাইকোর্ট। তাঁকে জামিন দেওয়া হলে তদন্তের কতটা কী ক্ষতি হতে পারে, প্রশ্ন তুলেছিলেন ডিভিশন বেঞ্চের অন্যতম সদস্য, বিচারপতি অসীম রায়। তবে সিবিআইয়ের আইনজীবী কে রাঘবচারিলুর আবেদন মেনে বিচারপতি রায় এবং বিচারপতি মলয়মরুত বন্দ্যোপাধ্যায়ের বেঞ্চ এ দিন জানিয়েছে, জামিনের মামলার নিষ্পত্তি করা হচ্ছে না। সেই কারণেই অন্তর্বর্তিকালীন জামিন মঞ্জুর করা হল। ২ নভেম্বর পরবর্তী শুনানি হবে।
এ দিন হাইকোর্ট যখন রায় ঘোষণা করছে, কুণাল তখন প্রেসিডেন্সি জেল-হাসপাতালের ৫ নম্বর ওয়ার্ডে বসে তাঁর উপন্যাসের শেষ পর্ব লিখতে ব্যস্ত। তার আগে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত জেলের অরবিন্দ ঘোষ সেলে প্রায় একটানা প্রার্থনা করেছেন। কোর্টের নির্দেশের কথা তাঁকে জানান জেলার, ডেপুটি সুপার এবং ডাক্তার। খোলা হয় টিভি। অন্য বন্দিরা অভিনন্দন জানান কুণালকে।
জামিনের খবর বাড়িতে বসেই শোনেন কুণালের স্ত্রী শর্মিতা ঘোষ। তাঁর সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া, ‘‘এত দিন পরে ন্যায়বিচার হল।’’ শ্বাসকষ্ট নিয়ে গত রবিবার থেকে মধ্য কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি কুণালের মা মণিকাদেবী। ছেলের জামিনের খবর তাঁকে জানান শর্মিতাই। কান্না চেপে রাখতে পারেননি বৃদ্ধা। বৌমাকে বলেছেন, ‘‘পুজোর আগে ছেলেটা বাড়ি ফিরছে। আমি খুব খুশি।’’
সারদা-কাণ্ডে ২০১৩ সালের ২৩ নভেম্বর কুণালকে গ্রেফতার করেছিল বিধাননগর (দক্ষিণ) থানা। তদন্তভার পেয়ে ২০১৪ সালের ৬ সেপ্টেম্বর কাগজে-কলমে কুণালকে ফের গ্রেফতার করে হেফাজতে নেয় সিবিআই। কুণালের আইনজীবীদের যুক্তি ছিল, কার্যক্ষেত্রে প্রায় তিন বছর বন্দি আছেন তাঁদের মক্কেল। সিবিআই পাল্টা যুক্তি দেয়, তারা কুণালকে হেফাজতে নিয়েছিল ২০১৪-য়। সুতরাং তিনি দু’বছর জেলে রয়েছেন বলে ধরতে হবে।
এ দিন ডিভিশন বেঞ্চ কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার সেই যুক্তি খারিজ না করেও বলেছে, ২০১৪ সালের ২২ অক্টোবর কুণালকে চার্জশিট দিয়েছিল সিবিআই। কিন্তু তাঁর কাছ থেকে কোনও তথ্যপ্রমাণ পায়নি। তারা জানিয়েছে, অভিযুক্তের বিরুদ্ধে তদন্ত আরও চার মাস চলবে। কিন্তু কমবেশি ৬২ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ কবে শুরু হবে, সিবিআইয়ের জানা নেই। এই পরিস্থিতিতে কুণালকে অন্তর্বর্তী জামিন মঞ্জুর করা বেআইনি হবে না। বেঞ্চের যুক্তি, কুণালের মামলা কলকাতার এক জন মেট্রোপলিটান ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে বিচারাধীন। তিনি কাউকে তিন বছরের বেশি সাজা দিতে পারেন না। কুণালের বিচারপর্ব এখনও শুরু হয়নি। তাই তাঁর জামিন পাওয়ার অধিকার সংবিধান সম্মত।
ঘনিষ্ঠ মহলে কুণাল বলেছেন, ‘‘ভগবানের উপর আস্থা রেখেছিলাম। আদালতকে ধন্যবাদ।’’ এ দিন অবশ্য জেল থেকে ছাড়া পাননি তিনি। তিনি বেরোতে পারেন আজ, বৃহস্পতিবার।
কাকতালীয়, কিন্তু আজ পঞ্চমী!