হাওড়া থেকে হোবার্ট জুড়ে ঘরে ফেরার গান

ভুল ট্রেনে উঠে ঘর হারিয়ে কত শিশুই আসে কলকাতায়। কিন্তু ক’জনের জীবন এমন আশ্চর্য মোড় নেয়! শুক্রবার সন্ধ্যায় ‘ইনফোকম ২০১৭’-এর আসরে সারু ব্রিয়ারলিকে দেখতে তাই মুখিয়ে ছিল গোটা সভাকক্ষ।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ ডিসেম্বর ২০১৭ ০৩:১৯
Share:

শহরে সারু ব্রিয়ারলি। —নিজস্ব চিত্র।

এই শহরের হাওড়া স্টেশন, রবীন্দ্র সেতু, হুগলি নদীর বিবর্ণ ঘাট বা কিছু রাস্তা দেখলে এখনও ছেলেবেলার সেই ঠান্ডা ভয়ের অনুভূতিটা তাঁকে ছুঁয়ে যায়। সেই শহরের সামনে দাঁড়িয়ে এ ভাবে নিজের কথা বলবেন, কখনও ভাবেননি তিনি।

Advertisement

ভুল ট্রেনে উঠে ঘর হারিয়ে কত শিশুই আসে কলকাতায়। কিন্তু ক’জনের জীবন এমন আশ্চর্য মোড় নেয়! শুক্রবার সন্ধ্যায় ‘ইনফোকম ২০১৭’-এর আসরে সারু ব্রিয়ারলিকে দেখতে তাই মুখিয়ে ছিল গোটা সভাকক্ষ।

সারুর লেখা বেস্টসেলার বই ও হলিউডি ছবি ‘লায়ন’-এর দৌলতে তাঁর জীবনকাহিনি ইতিমধ্যেই অনেকের জানা। অস্ট্রেলিয়ায় সাহেব মা-বাবার কাছে দত্তক সন্তান হিসেবে মানুষ হয়ে সারু এখন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। কয়েক বছর আগে নিজের অতীতের খুঁজতে শুরু করেন। যেখানে তাঁর জন্ম, মধ্যপ্রদেশের সেই জনপদের নাম ভুলে গিয়েছিলেন। হাওড়ায় আসার পথে ভুল ট্রেনে ওঠার স্টেশন বুরহানপুরের নামটা শুধু আবছা ভাবে মনে ছিল। গুগ্‌ল আর্থ-এর ছবি ঘেঁটে সেই স্টেশনকে খুঁজে বের করলেন তিনি। বাকিটা সত্যিই রূপকথা!

Advertisement

নিজের ঘরে ফেরার গল্প বলতে কলকাতায় এসে মধ্য তিরিশের সারু নিজেও কয়েক মুহূর্ত থমকে গিয়েছিলেন, ‘‘অদ্ভূত লাগছে!
আমার জীবন নিয়ে তৈরি ছবি অস্কারে যাওয়ার থেকে কম উত্তেজক নয় এই মুহূর্ত।’’

মধ্যপ্রদেশের স্টেশন থেকে কী ভাবে নিজের বাড়ি, মাকে খুঁজে পেলেন, কী ভাবেই বা সারুর পালক মা এবং গর্ভধারিণী মায়ের দেখা হল— সবই বলছিলেন তিনি। জায়ান্ট স্ক্রিনে দেখা গেল, এক দীর্ঘদেহী শ্বেতাঙ্গিনী মেমসাহেব ছলছলে চোখে জড়িয়ে ধরছেন, এক গ্রাম্য ভারতীয় প্রৌঢ়ার ছিপছিপে অবয়ব।

আজকের দুনিয়ায় মানুষের নানা কিসিমের খোপ-কাটা পরিচয়ের পটভূমিতে সারুর গল্প এক ধাঁধাও বটে! জন্মসূত্রে ভারতীয়, পাঁচ বছর বয়স থেকে অস্ট্রেলিয়ার হোবার্টবাসী সারু ক্রিকেটে কাদের সমর্থন করেন? ভারত না অস্ট্রেলিয়া? ‘যখন যারা জেতে তাদের,’ দর্শকাসন থেকে মজাদার প্রশ্নে পাল্টা রসিকতা করলেন সারুও।

বক্তৃতাশেষে নিজস্বী-শিকারীদের খুশি করে একান্তে বসে বলছিলেন, ‘‘আমার অতীত ঘাঁটার মধ্যে কিন্তু নিজের জীবন নিয়ে কোনও অতৃপ্তি ছিল না, এমন নয় যে ছোটবেলার পৃথিবীটায় ফিরতে চেয়েছিলাম আমি।’’ একটু থেমে সারুর প্রত্যয়ী স্বর ফের বলে, ‘‘কিন্তু আমার দুঃখিনী মায়েরও তো জানার অধিকার ছিল, তার ছেলেটার সঙ্গে কী ঘটেছে!’’ স্বামী-পরিত্যক্ত, ইটভাটার মজুর মায়ের সন্তান সারুর জন্ম একটি মুসলিম পরিবারে। পালক মা-বাবার কাছে ধর্মহীন ভাবেই বেড়ে উঠেছেন তিনি। বললেন, ‘‘আমি হিপিমনস্ক, বাঁধা গতের ধর্ম-সংস্কৃতি মানি না। আমার ভারতীয় পরিবার, অস্ট্রেলিয়ার মা-বাবা— সবাইকে নিয়েই বাঁচতে চাই!’’

কলকাতার অনাথ শিশুদের নিয়ে কিছু কাজেও জড়িয়ে সারু। কারণ নিজের জীবন তাঁকে শিখিয়েছে অসম্ভব বলে হয় না কিছুই। ‘‘একদিন যার কেউ ছিল না, আজ তার দু’দু’টি পরিবার!
এটা ভাবলে ধন্য মনে হয়!’’ ঝটিকা-সফরে কলকাতাকে বলে গেলেন, রূপকথার নায়ক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন