ছবি: কৌশিক সাঁতরা।
চিত্র এক: দাসপুর, ঘাটালের ইট ভাটায় সকাল হলেই মহিলারা চলে আসেন কাজ করতে। কোলে কয়েক মাসের শিশুকে নিয়েই তাঁরা ঠোঁটের ফাঁকে গুঁজে রাখেন বিড়ি। কারও পছন্দ কাঁচা তামাক অথবা গুটখা। কখনও বা বাবার সঙ্গে কাজ করতে আসে বছর বারোর ছোট্ট ছেলেটা। কাজের ফাঁকে টুকটাক ধূমপানের হাতেখড়িও এখানেই।
চিত্র দুই: বড় ব়ড় শহরে ইমারত গড়ার কারিগরিতে হামেশাই জুটে যায় চোদ্দো না-পেরোনো কিশোর। রাজ-মিস্ত্রীদের সঙ্গে অল্প খরচে কাজ চুকিয়ে নেওয়ার জন্য নাবালক ছেলেমেয়েদের যথেষ্ট কদর। বাচ্চাদের দিয়ে বেশি করে কাজ করিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে তাদের হাতে গুঁজে দেওয়া হয় তামাকের নানা উপকরণ। দাসপুরের লাউদা এলাকার এক রাজমিস্ত্রী সৈয়দ গোলাম শেখের স্পষ্ট স্বীকারোক্তি, “সবাই তো পেটের জ্বালায় খাটতে আসছে। বাচ্চারাও নতুন কাজে যোগ দিয়েছে। তাই ওই সব খাইয়ে কাজের প্রতি ওদের ঝোঁক বাড়ানো হয়।”
চিত্র তিন: মেদিনীপুর শহরের নামী স্কুল কলেজের সামনে দেদার বিকোয় বিড়ি, সিগারেট, তামাক, গুটখা। নব্বই দশকে কলেজ মানেই ছিল ধূমপান। এখন পরিণত হয়েছে নেশা। তাই তামাক হাতে আসছে স্কুলের গণ্ডী পেরনোর আগেই। বছর বারোতেই আঙুলের ফাঁকে জ্বলে সিগারেট।
স্কুল-কলেজের পড়ুয়াদের একটা বড় অংশ তামাকে আসক্ত। কিন্তু পরোক্ষ ধূমপানেও যে বিপদ বাড়ছে। এ সবের দায় কি এড়াতে পারেন প্রাপ্ত বয়স্করা? বারবার প্রশ্ন উঠছে প্রশাসনের সদিচ্ছা নিয়েও।
পশ্চিম মেদিনীপুরের মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক গিরীশচন্দ্র বেরা জানান, এ বার স্কুল-কলেজে সচেতনতা বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত হয়েছে। আলোচনা সভা, ম্যাজিক বা ক্যুইজের মাধ্যমেও চলবে এই সচেতনতা শিবির। গিরীশবাবু আশবাদী, “একজন সচে তন হলে সে নিজে আরও একশো জনকে সচেতন করতে পারে।” জেলা পুলিশ সুপার ভারতী ঘোষ জানিয়েছেন পাড়ার মোড়ে মোড়ে পুলিশি উদ্যোগেও আড্ডার আসর বসানো হবে। সেখানেই চলবে আলোচনা।
জেলা স্বাস্থ্য দফতরের সূত্রে খবর, ঠিক হয়েছে, আপাতত পশ্চিম মেদিনীপুরের ২৯টি ব্লকের একটি করে হাইস্কুলে এই সচেতনতা কর্মসূচি পালিত হবে। চারটি মহকুমার একটি করে কলেজে এই কর্মসূচি হবে। জেলার উপ-মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক তথা নোডাল অফিসার (তামাকজনিত রোগ সমূহ) রবীন্দ্রনাথ প্রধান বলেন, “এ দেশে তামাক সেবনের গড় ৩৫ শতাংশ, সেখানে এ রাজ্যে গড় ৩৬ শতাংশ। প্রতিটি সিগারেট মানুষের আয়ু ১১ মিনিট করে কমিয়ে দেয়। সচেতনতা কর্মসূচিতে এই সব দিক নিয়েই প্রচার চালানো হবে।”
চিকিৎসকদের একাংশ জানাচ্ছেন, তামাকের ব্যবহার এ দেশে প্রতি বছর প্রায় ৯ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর কারণ। এই সংখ্যা আগামী দিনে আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা। দেশে প্রতিদিন প্রায় ২,২০০ মানুষের মৃত্যু হয় তামাক ব্যবহার জনিত কোনও রোগের কারণে। দেশে ১০০ জন ক্যানসার চিকিৎসাধীন রোগীর মধ্যে ৪০ জন তামাক ব্যবহারজনিত। দেশে প্রায় ৫৭ শতাংশ পুরুষ এবং ১১ শতাংশ মহিলা কোনও না কোনও ধরণের তামাকে আসক্ত।
মঙ্গলবার ছিল বিশ্ব তামাক বর্জন দিবস। পশ্চিম মেদিনীপুরেও দিনটি পালিত হয়। জেলা স্বাস্থ্য দফতরের উদ্যোগে জেলা পরিষদের সভাকক্ষে আলোচনা সভা হয়। জুভেনাইল জাস্টিস অ্যাক্ট সংশোধন করে অপ্রাপ্তবয়স্কদের কাছে নেশার বস্তু বিক্রির সাজার মেয়াদ তিন বছর থেকে বাড়িয়ে সাত বছর করা হয়েছে। অবশ্য, জেলার সদর শহরে সেই আইন রয়েছে খাতায়-কলমে। তা কার্যকর করার কোনও উদ্যোগ নেই! স্কুল-কলেজের কাছেপিঠেই বিড়ি, সিগারেট, গুটখার দোকান। পয়সা দিলেই মেলে তামাকজাতীয় সব বস্তু। প্রকাশ্যে চলে ধূমপান।
জেলা পুলিশের এক কর্তার সাফাই, “হয়তো সব সময় সম্ভব হয় না, তবে মাঝেমধ্যে অভিযান চলে।” পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার ভারতী ঘোষও বলেছেন, “ওই আইনেই অন্তত নাবালকদের হাতে যাতে সিগারেট, তামাক না পৌঁছয় সে বিষয়ে পদক্ষেপ করা হবে। জেলা জুড়ে পুলিশি অভিযান শুরু হবে।” তবে তাঁর দাবি, “শুধু পুলিশ দিয়ে এই প্রবণতা বন্ধ করা যাবে না। অভিভাবক, শিক্ষক, চিকিৎসক-সহ সমাজের সমস্ত স্তরের মানুষকেই এগিয়ে আসতে হবে।’’
শিক্ষক সমাজে সচেতনতার অভাব নিয়ে মুখ খুলেছেন শিক্ষক সমাজেরই একাংশ। ঘাটালের এক স্কুল শিক্ষকের স্বীকারোক্তি, “আমরা স্কুলে ক্লাসের ফাঁকে গল্প-গুজবে মেতে থাকি। এমনকী আমরাও তো ছাত্র-ছাত্রীদের সামনেই ধূমপান করছি। আমরাও দায় এড়াতে পারি না।” ঘাটাল কলেজের টিচার-ইনচার্জ লক্ষীকান্ত রায় বলেন, “পরিচালন সমিতির বৈঠকেই আমরা এ বিষয়ে একটি প্রস্তাব রাখব। ছাত্রছাত্রী বা অন্য কেউ কলেজ চত্বরে ধূমপান করলেই কড়া ব্যবস্থা নেওয়া যায় কিনা তা নিয়ে আলোচনা হবে।” ঘাটাল কলেজের প্রাক্তন অধ্যাপক লক্ষ্মণ কর্মকারের পরামর্শ, “পাঠ্যক্রমে এ নিয়ে একটি সিলেবাস শুরু করলে ভাল হবে।” দাসপুরের এক স্কুল শিক্ষক তরুণ নস্করের কথায়, “কলেজের ছাত্র-সংসদ এমনকী ক্লাবগুলিরও তো একটা ভূমিকা পালন করা উচিত। সবাই সচেতন হলে তবেই এ রোগ নির্মূল হওয়া সম্ভব।”
পুলিশেরই একটি সূত্র জানাচ্ছে, শুধু বিড়ি, সিগারেট, মদ, গাঁজা নয়। হেরোইন, চরস, ব্রাউন সুগার এমনকী বহু অপ্রচলিত বা স্বল্পপরিচিত মাদকও ঢুকে পড়ছে মেদিনীপুর-সহ জেলার প্রত্যন্ত এলাকাগুলিতেও। সহজে পৌঁছে যাচ্ছে অপ্রাপ্তবয়স্কদের কাছে। মেদিনীপুরের এক নেশামুক্তি কেন্দ্রের কর্মী মানছেন, “এখন যারা মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে, তারমধ্যে যেমন লেখাপড়া না-জানা ছেলে রয়েছে, তেমন মেধাবী ছেলেও রয়েছে। উদ্বেগ এখানেই। যাঁরা মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন, তাঁদের মধ্যে অল্প কয়েকজনই সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফেরে।”