পাশে ‘স্বজনেরা’, সুস্থ হচ্ছে অগ্নিদগ্ধ সেই বছর তেরোর আকিবুল

উত্তর ২৪ পরগনার দেগঙ্গার বছর তেরোর আকিবুল দফাদার। মাত্র এক বছর বয়সে মারা গিয়েছিলেন বাবা। চলতি বছরের জানুয়ারিতে এক দিন বারান্দায় বসে পড়ছিল আকিবুল।

Advertisement

অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ নভেম্বর ২০১৮ ০১:০৫
Share:

চিকিৎসার পরে ফের দাঁড়াতে পারছে আকিবুল। ছবি: সজলকুমার চট্টোপাধ্যায়

সারা শরীর পুড়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছিল ছেলেটি। চিকিৎসার খরচই বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছিল মায়ের কাছে। কিন্তু অসহায় মায়ের পাশে ‘দশ জন’ এগিয়ে আসায় সেই ছেলেই আজ বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। হাঁটছেও।

Advertisement

উত্তর ২৪ পরগনার দেগঙ্গার বছর তেরোর আকিবুল দফাদার। মাত্র এক বছর বয়সে মারা গিয়েছিলেন বাবা। চলতি বছরের জানুয়ারিতে এক দিন বারান্দায় বসে পড়ছিল আকিবুল। পাশে রান্না করছিলেন মা মোসলিমা বিবি। আচমকা উনুনের আগুন থেকে জ্বলতে শুরু করে ঘর। অগ্নিদগ্ধ হয় সপ্তম শ্রেণির আকিবুল। ছেলেকে বাঁচাতে গিয়ে পুড়ে যান মোসলেমাও।

প্রতিবেশীরাই তাদের হাসপাতালে নিয়ে যান। পা থেকে মাংস নিয়ে আকিবুলের শরীরে ‘গ্রাফটিং’ করেন আর জি করের চিকিৎসকেরা। পাঁচ মাস পরে ছুটি দেওয়া হয়। এর পরেই শুরু যন্ত্রণার। দু’দিন অন্তর ড্রেসিং করাতে মাসে ১৮ হাজার, হাসপাতালে মাসে দু’বার নিতে গাড়ি ভাড়ার টাকা জোগাড় করতে পারছিলেন না মোসলেমা। অন্যের বাড়িতে ঠিকা কাজ করে সামান্য আয়। কিন্তু সারাক্ষণ ছেলেকে দেখতে গিয়ে আয়ের পথটুকুও বন্ধ। চিকিৎসার অভাবে কাবু হয়ে পড়ছিল ছাত্রটি।

Advertisement

উপশম: পুড়ে যাওয়ায় শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছিল আকিবুল।

ক্ষতস্থানে পচন ধরছিল। দু’পায়ের মাংস কেটে শরীরে লাগানোর পরে আকিবুলের পা-ও সোজা হচ্ছিল না। শুধু তার মুখে ছিল একটাই কথা, ‘আমি আবার স্কুলে যাব।’ মায়ের আকুল আর্তি ছিল, ‘‘একমাত্র ছেলেটাকে বাঁচান।’’ সেই আর্তি পৌঁছে ছিল রাজ্যে, ভিন্‌ দেশের মানুষের কাছেও। এর পরেই সাহায্যে এগিয়ে আসেন বহু মানুষ।

শ্যামবাজার থেকে এক দম্পতি এসেছিলেন আকিবুলের বাড়িতে। তুলে দিয়েছেন পাঁচ হাজার টাকা। মোসলেমা জানান, ওই দম্পতির দিদিও আগুনে পুড়ে মারা যান। তাই টাকার অভাবে যাতে আকিবুলের চিকিৎসা বন্ধ না হয়, সে জন্য সচেষ্ট হন। বারাসতের এক ব্যবসায়ী শান্তনু বক্সী আকিবুলকে নার্সিংহোমে রেখে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। শান্তনু বলেন, ‘‘অভাবের জন্য ছেলেটা মারা যাবে মেনে নিতে পারিনি। পাশে পেয়েছিলাম দুই বন্ধুকেও।’’

ইদের মরসুমেও খাট ছেড়ে উঠতে পারেনি আকিবুল। তাকে জামা-প্যান্ট দিয়ে সিমুই খাইয়ে যান বাদুড়িয়া, হাবড়ার অনেকে। বাড়িতে এসেছিলেন বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট হাইস্কুলের প্রাক্তন ছাত্ররাও। তুলে দিয়েছিলেন ৪৪ হাজার টাকা ও চিকিৎসা-সরঞ্জাম। তাঁদেরই এক জন নবারুণ সাহা বলেন, ‘‘এক ছাত্র পোড়ার যন্ত্রণা নিয়ে বাড়িতে ছটফট করছে জানতে পেরেই গিয়েছিলাম।’’ বসিরহাটের দীপাবলি নাথ বলেন, ‘‘ও সুস্থ হচ্ছে, এটাই তো আনন্দের।’’

মঙ্গলবার তখন আকিবুলের পায়ে ফিজিয়োথেরাপি আর ক্ষতস্থানে ড্রেসিং চলছে। যে ছেলে ক’দিন আগেও এ পাশ-ও পাশ করতে পারছিল না, এ দিন ড্রেসিং শেষ হতেই সে বলে ওঠে ‘‘আমি দাঁড়াতে পারি, দেখবে? দেখলে কিন্তু ব্যাডমিন্টন কিনে দিতে হবে।’’ কথা শেষ না হতেই লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে আকিবুল।

শুধু দাঁড়ানোই নয়, ছোট্ট বাচ্চাদের মতো ঘরময় হেঁটে বেড়ায় সে। বাইরেও আসে। আকিবুলের আবদার মেনে দু’টি র‌্যাকেট, এক বাক্স কর্ক কিনে এনেছেন বেড়াচাঁপার যুবক আন্টু মণ্ডল। আকিবুলের ড্রেসিং-খরচের দায়িত্ব নিয়েছেন তিনি।

মোসলেমা বলেন, ‘‘দিন-রাত ছেলেটাকে পাখার হাওয়া করতে করতে ভাবতাম, ও তো আর থাকবে না, তার পরে আমিও...।’’

কান্না সামলে হাসিমুখে এ বার মা বলেন, ‘‘খবরের কাগজ কখনও পড়িনি। খবর পড়ে কত মানুষ এসেছেন। ওকে এ বার স্কুলে পাঠাব।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন