বকেয়া বিলে চাপা পড়েছে শিশুসাথি

সকাল থেকে হাসপাতালে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকা। দিনের শেষে হতাশ হয়ে ফেরা। সাড়ে তিন বছরের রজব শেখের পরিবারে গত ছ’মাস এমনই নিষ্ফলা। বহরমপুরের খাগড়ার বাসিন্দা রজব জন্মাবধি হার্টের জটিল রোগে আক্রান্ত।

Advertisement

সোমা মুখোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০৩:৪৫
Share:

সকাল থেকে হাসপাতালে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকা। দিনের শেষে হতাশ হয়ে ফেরা।

Advertisement

সাড়ে তিন বছরের রজব শেখের পরিবারে গত ছ’মাস এমনই নিষ্ফলা। বহরমপুরের খাগড়ার বাসিন্দা রজব জন্মাবধি হার্টের জটিল রোগে আক্রান্ত। একটা অস্ত্রোপচার তার জীবনটা বদলে দিতে পারে। সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী, রাজ্যের একাধিক বেসরকারি ও সরকারি হাসপাতালে নিখরচায় তা করানোর ব্যবস্থাও রয়েছে। কিন্তু গত ছ’মাস ধরে হাসপাতালে গিয়ে বাবা-মাকে শুনতে হচ্ছে একটাই কথা— এখন কিছু হবে না, পরে আসুন।

পশ্চিমবঙ্গে এই মুহূর্তে রজবের মতো কয়েক হাজার শিশু এমন জরুরি অস্ত্রোপচারের প্রতীক্ষায়। অনেকের অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। অসহায় মা-বাবা দোরে দোরে মাথা কুটছেন। আর সব মিলিয়ে সূচনার আড়াই বছরের মধ্যেই পথে বসতে চলেছে মুখ্যমন্ত্রীর সাধের ‘শিশুসাথি’ প্রকল্প। যার মাধ্যমে শিশু হৃদ্‌রোগীদের বিনা পয়সায় অস্ত্রোপচার করানোর পরিকল্পনা নিয়েছিল রাজ্য সরকার।

Advertisement

এবং এর মূল কারণ, খরচের বিল মেটানো ঘিরে টানাপড়েন। সরকারের দাবি, টাকার অভাব নেই। অথচ হাসপাতালগুলোর অভিযোগ, মাসের পর মাস তাদের বিল ফেলে রাখা হচ্ছে। ফলে বিভিন্ন হাসপাতালে শিশু হৃদ্‌রোগীদের অস্ত্রোপচার নিয়ে নানা টালবাহানা। ইতিমধ্যে অসংখ্য অভিযোগ জমা পড়েছে স্বাস্থ্য ভবনে। দফায় দফায় বৈঠক হয়েছে। এমনকী, স্বাস্থ্য-অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী গত সপ্তাহে সমস্ত পক্ষকে ডেকে কড়া নির্দেশ দিয়েছেন, চলতি মাসের মধ্যে সমস্যা মিটিয়ে শিশুসাথিকে ফের ছন্দে ফেরাতে হবে। যদিও হুকুমের কার্যকারিতা সম্পর্কে সংশয় ঘুরপাক খাচ্ছে দফতরের অন্দরে।

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে শিশুসাথির উদ্বোধন হয়েছিল ২০১৩-র অগস্টে। প্রকল্পের আওতায় শিশু হৃদ্‌রোগীদের অস্ত্রোপচারের জন্য চিহ্নিত করা হয়েছে সরকারি স্তরে এসএসকেএম এবং চারটি বেসরকারি হাসপাতালকে। ঘোষণা অনুযায়ী, সেখানে নিখরচায় অস্ত্রোপচার করানো যাবে। রাজ্য সরকার হাসপাতালকে খরচের টাকা দিয়ে দেবে।

ঘটনা হল, মুখ্যমন্ত্রী শিশুসাথিকে রাজ্যের ‘সাফল্য-তালিকা’য় রাখলেও জননী সুরক্ষার মতো এর টাকা মূলত কেন্দ্রই জোগায়। স্বাস্থ্য-সূত্রের খবর: শিশুদের হার্ট অপারেশনের ৭৫% ব্যয়ভার কেন্দ্রের, ২৫% দেওয়ার কথা রাজ্যের। এ দিকে পশ্চিমবঙ্গ সরকার চুক্তিবদ্ধ বড় বড় হাসপাতালকে বলে দিয়েছে ২৫% ছাড় দিতে, যাতে রাজ্যের তহবিল থেকে এক পয়সাও না-বেরোয়। বিনিময়ে স্বাস্থ্য ভবনের আশ্বাস, প্রচুর রোগী আসবে, তাই মুনাফায় ঘাটতি হবে না। অস্ত্রোপচারের ৩০ দিনের মধ্যে বিল মেটানোর কথাও বলা ছিল চুক্তিতে।

বাস্তব যদিও অন্য রকম। কারও ১০ কোটি, কারও ১২ কোটি বকেয়া। এক হাসপাতাল-কর্তার অভিযোগ, টাকা পেতে ছ’মাস-আট মাস, এমনকী এক বছরও গড়িয়ে যাচ্ছে। ‘‘বাচ্চাদের হার্ট অপারেশনের জন্য আলাদা পরিকাঠামো বানাতে হয়েছে, একাধিক ডাক্তার নিয়োগ করতে হয়েছে। সে সব কী ভাবে বজায় রাখব?’’— প্রশ্ন তাঁর। সঙ্গে আক্ষেপ, ‘‘সরকারি প্রকল্প চালাতে গিয়ে আমরাই তো দেখছি ফতুর হয়ে যাব!’’

সরকারের কী বক্তব্য?

স্বাস্থ্য-অধিকর্তার দাবি, ‘‘টাকার অভাব নেই। বিল নিয়ে কিছু সমস্যা চলছিল। তাড়াতাড়ি মিটিয়ে নিতে বলেছি।’’ বিশ্বরঞ্জনবাবু জানান, বিলের নতুন ফরম্যাট চালু হচ্ছে। যত দ্রুত সম্ভব অনলাইন বিলিং চালু হবে। ‘‘তা হলে আর দেরি হবে না।’’— প্রত্যয়ী ঘোষণা অধিকর্তার। কিন্তু রাজ্যকে তো কার্যত কিছুই দিতে হচ্ছে না! সবই কেন্দ্রের টাকা। তবু দেরি কেন?

আঙুল উঠছে লাল ফিতের দিকে। যার এক-একটা ফাঁস ছাড়াতেই প্রশাসন জেরবার। স্বাস্থ্য ভবন-সূত্রের কথায়, ‘‘বিল স্যাংশন হয়ে চেক পাঠানো— সমস্ত ধাপে দেরি-ই দেরি। একটা প্রকল্পকে গতি দিতে যে সদিচ্ছা দরকার, তার যথেষ্ট অভাব রয়েছে।’’

পরিণাম যা হওয়ার, তা-ই। বেসরকারি হাসপাতালে তো বটেই, শিশুসাথিতে অস্ত্রোপচারের সংখ্যা কমেছে এসএসকেএমেও। এক-একটা অপারেশনের অনুমোদন আদায়ে যা সময় লাগছে, তাতে ডাক্তার থেকে আধিকারিক, সকলে বীতশ্রদ্ধ। এক কর্তার খেদ, ‘‘যার ছাড়পত্র চব্বিশ ঘণ্টায় আসার কথা, তা এক মাসেও মিলছে না! অথচ মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, এ নাকি তাঁর স্বপ্নের প্রকল্প!’’

তা সত্ত্বেও শিশুসাথির পথে এত বাধা কেন, স্বাস্থ্য-প্রশাসনে সেই প্রশ্ন প্রকট। অনুসন্ধানে অবশ্য ধরা পড়ছে, গলদটা একেবারে গোড়ায়। শুধু বিল মেটানোয় নয়, প্রকল্পের প্রতি পদক্ষেপেই হোঁচটের গল্প। কী রকম?

স্বাস্থ্য ভবনের খবর: প্রকল্পটি দেখভালের জন্য আলাদা কোনও ইউনিট-ই নেই। ধরা যাক, শিশুদের আয়রন ক্যাপসুল খাওয়ানোর দায়িত্ব যাঁর, তাঁকে শিশুসাথির বিলের প্রাথমিক খসড়াও দেখতে হচ্ছে। কিংবা পরিবারকল্যাণের হাজারো খুঁটিনাটি নিয়ে ব্যতিব্যস্ত অফিসারকে শিশুসাথি নিয়েও মাথা ঘামাতে হচ্ছে। আর এ ভাবে এক সঙ্গে অনেক কিছু করতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ছে বহু কাজ।

স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে, এ হেন গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে পৃথক কর্মী রাখা হয়নি কেন? যার সদুত্তর কর্তাদের থেকে মিলছে না। এমতাবস্থায় স্বাস্থ্য মহলের বড় অংশের আশঙ্কা, চুক্তিবদ্ধ হাসপাতালগুলো এ বার শিশুসাথির ‘ফাঁস’ থেকে পরিত্রাণের রাস্তা খুঁজবে।

অর্থাৎ, রজব শেখদের ভবিতব্য অনিশ্চিত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন