পথ বদলে ‘মগ দস্যু’ ও-পারে, তবু দুর্ভোগ

দস্যু রত্নাকরের মন পরিবর্তনে ঠিক কত সময় লেগেছিল, রামায়ণে সেই দিনগত পরিসংখ্যান তেমন স্পষ্ট নয়। তবে ‘মগ দস্যু’র মন ও মতি মোটামুটি ২৪ ঘণ্টাতেই বদলে যাওয়ায় এ-যাত্রায় রক্ষা পেয়ে গেল পশ্চিমবঙ্গ।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ অগস্ট ২০১৬ ০৩:১৫
Share:

ডুবল নোঙর করা স্টিমার। বাবুঘাটের কাছে রবিবার।

দস্যু রত্নাকরের মন পরিবর্তনে ঠিক কত সময় লেগেছিল, রামায়ণে সেই দিনগত পরিসংখ্যান তেমন স্পষ্ট নয়। তবে ‘মগ দস্যু’র মন ও মতি মোটামুটি ২৪ ঘণ্টাতেই বদলে যাওয়ায় এ-যাত্রায় রক্ষা পেয়ে গেল পশ্চিমবঙ্গ।

Advertisement

এ-পার বাংলার দিকে ধেয়ে আসতে আসতে মগ দস্যু নিম্নচাপ হঠাৎই পথ পরিবর্তন করে ঢুকে পড়েছে ও-পার বাংলায়! রবিবার দুপুরে ফরিদপুর জেলা এবং সংলগ্ন এলাকায় তার ঝোড়ো হামলায় ঘটেছে প্রাণহানিও। তবে এ-পারে তার দস্যুপনা দিনভর ঘ্যানঘেনে বৃষ্টির উপর দিয়েই গিয়েছে। আজ, সোমবার বিকেল থেকে আবহাওয়ার উন্নতি হবে বলে জানাচ্ছে হাওয়া অফিস।

‘‘যাক, এ-যাত্রায় বাংলা অন্তত মগের মুলুক হয়ে উঠল না,’’ স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে রবিবার সন্ধ্যায় বললেন এক আবহবিজ্ঞানী। উপগ্রহ-চিত্র বিশ্লেষণ করে আলিপুর আবহাওয়া দফতরের বিজ্ঞানীরা জানান, এ দিন সন্ধ্যায় মায়ানমারের নিম্নচাপের অবস্থান ছিল বাংলাদেশ এবং লাগোয়া দক্ষিণবঙ্গের উপরে। রাতে তার আরও উত্তর-পশ্চিমে সরে যাওয়ার কথা। কেন্দ্রীয় আবহাওয়া দফতরের ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল (পূর্বা়ঞ্চল) গোকুলচন্দ্র দেবনাথ জানান, সোমবার উত্তর ২৪ পরগনা, নদিয়া, মুর্শিদাবাদে বৃষ্টি হবে। বিকেল থেকে আবহাওয়ার দ্রুত উন্নতি হবে কলকাতা-সহ দক্ষিণবঙ্গে।

Advertisement

এত সহজে রেহাই মিলবে, আশা করেননি আবহবিজ্ঞানীরা। মায়ানমার থেকে সাগরপথে নিম্নচাপকে ধেয়ে আসতে দেখে শনিবার রীতিমতো প্রমাদ গুনছিলেন তাঁরা। বলেছিলেন, ওই নিম্নচাপের হানায় অতিভারী বৃষ্টি তো হবেই। বানভাসিও হয়ে পড়তে পারে গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গের কোনও কোনও জেলা! আর মায়ানমার থেকে বাংলার পথে সাগর পাড়ি দিতে দেরি হলে তো কথাই নেই।

কয়েক দিন আগে দক্ষিণ চিন সাগরে জন্ম নিয়েছিল ‘দিয়ানমু’ নামে একটি ঘূর্ণিঝড়। ভিয়েতনামে আছড়ে পড়ার পরে সে পৌঁছে যায় মায়ানমারে (আগেকার আরাকান, যেখান থেকে একদা হানা দিত মগ দস্যুরা)। সাধারণ ভাবে ঘূর্ণিঝড় স্থলভূমিতে আছড়ে পড়ার পরে শক্তি খুইয়ে নিম্নচাপে পরিণত হয় এবং ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যায় পরিমণ্ডলে। মায়ানমারে ঢুকে শক্তি খোয়াতে খোয়াতে দিয়ানমু নিম্নচাপে পরিণত হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু তত ক্ষণে সে আবার পৌঁছে গিয়েছিল বঙ্গোপসাগরের উপরে।

খুব জল, ডুব জল। গঙ্গায় জল বেড়ে বানভাসি মন্দির। রবিবার, বাবুঘাটে।

আবহবিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, বঙ্গোপসাগরের সক্রিয় মৌসুমি বায়ু ও নিম্নচাপ অক্ষরেখার টানে নিম্নচাপটি গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গের দিকে এগোতে শুরু করেছিল। সেই পথ পরিক্রমা এবং পরিমণ্ডলের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেই তাঁরা আশঙ্কা করছিলেন, সে গভীর নিম্নচাপে পরিণত হতে পারে। তাই অতিভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল। বিপদ-সঙ্কেত ছিল নিম্নচাপের সম্ভাব্য হামলার মধ্যেই। কী রকম বিপদ?

এক আবহবিদের ব্যাখ্যা, অগস্টের গোড়া থেকে পরপর নিম্নচাপের বৃষ্টিতে জলাধারগুলি ভরে রয়েছে। এই পর্যায়ে এসে আবার অতিভারী বর্ষণ হলে জল ছাড়তেই হতো। ভরা কোটালের জন্য নদীগুলিও টইটম্বুর। ফলে জলাধার থেকে অতিরিক্ত জল ছাড়া হলে বন্যা-পরিস্থিতি তৈরির আশঙ্কা ষোলো আনা।

অতিভারী বৃষ্টির জেরে বানভাসি পরিস্থিতির আঁচ পেয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। জল ছাড়া নিয়ে তোপ দেগেছিলেন কেন্দ্রের বিরুদ্ধে। পরিস্থিতি সামাল দিতে আগেভাগে পদস্থ ইঞ্জিনিয়ারদের মোতায়েন করেছিল সেচ দফতর। রাজ্যকে না-জানিয়ে মাইথন ও পাঞ্চেত থেকে যাতে আদৌ জল ছাড়া না-হয়, সেই ব্যাপারে চিঠি দেওয়া হয় ডিভিসি-কে। এ দিন আবহাওয়ার উন্নতির আশা দেখে কিছুটা চিন্তামুক্ত হয়েছেন সেচকর্তারা। তবে টানা বৃষ্টিতে কলকাতা-সহ গাঙ্গেয় বঙ্গে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে সারা দিনই। জল যে মোটেই ছাড়া হয়নি, তা-ও নয়। সেচ দফতরের খবর, মাইথন ও পাঞ্চেত থেকে এ দিন বেলা পৌনে ১১টা নাগাদ ৫৪ হাজার কিউসেক এবং দুর্গাপুর ব্যারাজ থেকে ৭০ হাজার কিউসেক জল ছাড়া হয়েছে। ভরা কোটালের জন্য হাওড়ার আমতার কাছে দামোদরের জলস্তর বিপদসীমার উপর দিয়ে বইছে। জারি করা হয়েছে সতর্কতাও। তবে হুগলির খানাকুল-২ ব্লক সূত্রের খবর, রবিবার রাত পর্যন্ত যে-বৃষ্টি হয়েছে এবং ডিভিসি যে-জল ছেড়েছে, তাতে কোনও বিপদবার্তা নেই। রবিবার রাতে মহানগর ও গঙ্গার পরিস্থিতি পরিদর্শনের পরে মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের আশ্বাস, আশঙ্কার কোনও কারণ নেই। সোমবার বিকেল থেকে আবহাওয়ার উন্নতি হলে পরিস্থিতির আর অবনতি হবে না বলে আশা সেচ দফতরেরও।

সেই আশার মূলে আছে মগ-দস্যুর মন ও পথ পরিবর্তন। আবহবিদেরা বলছেন, নিম্নচাপ এ-পার বাংলার পথ বদলে ও-পারের রাস্তা ধরায় শক্তি বাড়াতে পারেনি। সাগরের উপরে থাকলে জলীয় বাষ্প শুষে শক্তি বাড়িয়ে নিতে পারত সে। বাংলাদেশে ঢুকে পড়ায় স্থলভূমি থেকে সে-ভাবে জোলো হাওয়ার জোগান মেলেনি। তাই যতটা বৃষ্টি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছিল, ততটা হয়নি। নিম্নচাপটি সে-ভাবে শক্তি বাড়াতে না-পারায় দক্ষিণবঙ্গে বানভাসি পরিস্থিতিও এড়ানো যাবে বলে মনে করছেন আবহবিদেরা।

হাওয়া অফিসের খবর, শক্তি বৃদ্ধি না-হলেও নিম্নচাপটির প্রভাবে ভোর থেকেই বৃষ্টি চলে কলকাতা-সহ গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে। সারা দিনে সূর্যের দেখা মেলেনি। টানা বৃষ্টিতে তাপমাত্রাও অনেকটা নেমে গিয়েছে। এ দিন কলকাতার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ২৮.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস, স্বাভাবিকের থেকে চার ডিগ্রি কম। সারা দিন বৃষ্টি হলেও সেই বর্ষণে জোর বিশেষ ছিল না। বেশি বৃষ্টি হয়েছে মহানগরী এবং উত্তর ২৪ পরগনার বাংলাদেশ সংলগ্ন এলাকায়। বিকেল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত মহানগরে বৃষ্টি হয়েছে সাকুল্যে ২১.৭ মিলিমিটার। রাত সাড়ে ৯টায় সেটা বেড়ে দাঁড়ায় ৩১.২ মিলিমিটারে।

এ-পার রেহাই পেলেও নিম্নচাপের দাপটে বাংলাদেশের কিছু অঞ্চলকে ভুগতে হয়েছে। ফরিদপুর ও সন্নিহিত এলাকায় ঝড়ে একটি চটকলের ছাউনি ভেঙে পড়ায় তিন শ্রমিক মারা যান। গ্রামাঞ্চলে গাছ চাপা পড়ে মৃত্যু হয় দু’জনের। ভেঙেছে বহু ঘরবাড়িও।

ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন