আশাহত টলিউড

ফিল্ম সিটির বদলে কেন উপনগরী, প্রশ্ন

স্রেফ ইট-কাঠ-সিমেন্ট নয়! সিনেমা-টিভিও যে বড় মাপের শিল্প, তা বারবার বলে থাকেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু বাস্তবে কলাশিল্প থেকে বাণিজ্যের পরিসরে তার উত্তরণ যে এ রাজ্যে কথার কথা, তার আরও একটি সাক্ষ্য রয়ে গেল উত্তরবঙ্গে।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ২২ মে ২০১৫ ০৩:৫৩
Share:

কাওয়াখালিতে প্রস্তাবিত তিস্তা উপনগরী প্রকল্পের জায়গা ঘুরে দেখছেন পুর ও নগরোন্নয়ন দফতরের প্রধান সচিব দেবাশিস সেন। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক।

Advertisement

স্রেফ ইট-কাঠ-সিমেন্ট নয়! সিনেমা-টিভিও যে বড় মাপের শিল্প, তা বারবার বলে থাকেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু বাস্তবে কলাশিল্প থেকে বাণিজ্যের পরিসরে তার উত্তরণ যে এ রাজ্যে কথার কথা, তার আরও একটি সাক্ষ্য রয়ে গেল উত্তরবঙ্গে।

Advertisement

শিলিগুড়িতে মহানন্দা নদীর ধারে প্রস্তাবিত ফিল্ম সিটি যে হবে না, সেটা গত মাসে নিজেই ঘোষণা করে গিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। রাজ্যের আর পাঁচটি শহরের সঙ্গে এখানে ‘তিস্তা উপনগরী’ তৈরির সিদ্ধান্তের কথাও তিনি জানান। বৃহস্পতিবার ফিল্মসিটির জমিতে সেই উপগনরী গড়ারই তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল। এ দিন শিলিগুড়ি ফিল্ম সিটি-র নির্দিষ্ট জায়গাটি ঘুরে দেখলেন উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব এবং নগরোন্নয়ন দফতরের প্রধান সচিব দেবাশিস সেন।

মন্ত্রী এ দিন বলেন, ‘‘তিস্তা উপনগরীতে শুধু বাড়িঘর নয়, ‘নলেজ হাব’ তৈরি হবে। মেডিক্যাল ও এডুকেশনাল হাব গড়ে উঠবে। আগামী ৩-৪ মাসের মধ্যে পুরোদমে কাজ শুরু হয়ে যাবে।’’ সরকারি সূত্রের খবর, ৮৪.৮১ একরের ঘেরা জমির ২৫ শতাংশে এই হাব হবে। সেখানে দেশ-বিদেশের চিকিৎসা ও নার্সিংয়ের তালিম এবং পঠনপাঠনের সংস্থাকে টেন্ডারের মাধ্যমে জমি দেওয়া হবে। বাকি জমিতে আবাসন, ফ্ল্যাটবাড়ি এবং সৌন্দর্যায়ন করা হবে।

আর ফিল্মসিটি? পিপিপি মডলে হায়দরাবাদের অনুকরণে ফিল্ম সিটি করার কথা বলেছিল সরকার। প্রকল্পের খরচ ধরা হয়েছিল প্রায় ৪১০ কোটি টাকা। এখন মন্ত্রী বলছেন, ‘‘নতুন প্রকল্পেও একটি অংশ ফিল্ম সিটির জন্য রাখা থাকছে।’’ কিন্তু আবাসন, নলেজ হাব গড়ে ফিল্মসিটি কতটা কী হবে, তা নিয়ে অবশ্য সন্দেহ রয়েছে প্রশাসনের অন্দরেই। হতাশ টলিউডও।

গত কয়েক বছর ধরে বিনোদন জগতের সান্নিধ্যে বিভিন্ন আসরে মুখ্যমন্ত্রী বারবার সগর্বে ঘোষণা করেছেন, শিলিগুড়ি ও উত্তরপাড়ায় ফিল্ম সিটি গড়তে চলেছে সরকার। উত্তরপাড়ায় জমি নিয়ে আইনি জটিলতা ছিল। পরে একটি পেশাদার সংস্থাকে দিয়ে ওই তল্লাটে সমীক্ষা করানোর পরে গঙ্গার ভাঙনপ্রবণ কূলে ফিল্ম সিটি গড়ার বাস্তবতা নিয়েও প্রশ্ন উঠে যায়। শেষমেশ হাল ছেড়ে দেয় রাজ্য সরকার। উত্তরপাড়ার জমিটিতে ফের এখন আগের মতো ইটভাটা গজিয়ে উঠতে শুরু করেছে।

এ বার শিলিগুড়ি ফিল্ম সিটিরও ভরাডুবি ঘটল। খোদ মুখ্যমন্ত্রী তথা শাসক দলের সঙ্গে বিনোদন জগতের এত ঘনিষ্ঠতা সত্ত্বেও ইন্ডাস্ট্রির ঝুলিতে তবে কী এল, তা নিয়ে প্রশ্নও উঠতে শুরু করল। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পরিচালক তথা অভিনেতা যেমন বলছেন, ‘‘যা দেখছি, বিনোদন জগত ও রাজনীতির জগতের মাখামাখিতে শাসক দলের প্রচার-সভা বা সরকারি অনুষ্ঠানে গ্ল্যামারের পরিমাণ হয়তো বাড়ছে, কিন্তু ইন্ডাস্ট্রির লাভ যৎসামান্য।’’ ঠিক এক দিন আগে, বুধবারই টালিগঞ্জকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য একটি প্রভাবশালী ফিল্ম প্রযোজক গোষ্ঠীকে বঙ্গবিভূষণে ভূষিত করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। সেই ঘটনার দিকে ইঙ্গিত করে টালিগঞ্জের আর এক পরিচিত পরিচালকের কটাক্ষ, ‘‘ইন্ডাস্ট্রি নয়, বর্তমান জমানায় শাসক দলের ঘনিষ্ঠ কোনও কোনও গোষ্ঠীর উন্নতি হয়েছে!’’

টালিগঞ্জের যে পরিচালক-প্রযোজক ও শিল্পীরা এক সময় শিলিগুড়ির ফিল্মসিটির জমি দেখতে গিয়েছিলেন, সেই দলে ছিলেন পরিচালক হরনাথ চক্রবর্তী। এ দিন ফিল্মসিটি হচ্ছে না শুনে আক্ষেপ ঝরে পড়েছে তাঁর গলায়। ‘‘ফিল্মসিটির কাছেই পাহাড়-জঙ্গলের চমৎকার লোকেশন! ভাবনাটা ছিল, সকালে আউটডোর সেরে যাতে সন্ধেয় স্টুডিওর কাজটাও সেরে নেওয়া যায়। কে জানে, কেন হল না!’’ একই কথা বলছেন, অভিনেত্রী-প্রযোজক ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত। তাঁর কথায়, ‘‘ইন্ডাস্ট্রির কাজকর্ম শিলিগুড়ির ফিল্মসিটি হলে অবশ্যই গতি পেত। অন্য রাজ্য থেকেও অনেকে এখানে কাজ করতে আসতেন। না-হওয়াটা ভাল খবর নয়।’’ প্রযোজক রানা সরকারের কথায়, ‘‘বাংলা ছবিকে এখনও বহু ক্ষেত্রেই দরকারে মুম্বই, হায়দরাবাদে ছুটতে হয়। কয়েকটি বেসরকারি ফিল্ম সিটি বা স্টুডিও গড়ে উঠলে অনেক সুবিধে হতো।’’

বাম আমলে কাওয়াখালি উপনগরী গড়ার কথা বলে মহানন্দা নদীর পাশে ৩০২ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল। নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর তার একটি অংশ ফিল্ম সিটির জন্য চিহ্নিত করে। গত তিন বছরে একাধিক বার পরিচালক, অভিনেতা, শিল্পপতিরা জমিটি ঘুরেও দেখেন। কিন্তু একাধিকবার টেন্ডারে বিফল হয়ে চলতি মাসের গোড়ায় শিলিগুড়িতে এসে ফিল্ম সিটির প্রকল্প আর হচ্ছে না বলে ঘোষণা করেন মমতা। বাম জমানায় রাজ্যের পুরমন্ত্রী, অধুনা শিলিগুড়ির মেয়র অশোক ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘এক-একবার এক-এক রকম বলা হচ্ছে। পাঁচ বছর হতে চলল। কিছুই তো এখনও হল না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন