কেন্দ্রের মান্যতা চায় সীতাভোগ-মিহিদানা

বর্ধমানের কথা উঠলেই পত্রপাঠ নাম দু’টো জুড়ে দেওয়া বাঙালির বহু বছরের অভ্যাস। ওই নাম করতে করতেই তার মনে পড়ে ফুরফুরে সাদা আর গুঁড়ো গুঁড়ো হলুদরঙা, মুখে দিতে না দিতেই মিলিয়ে যাওয়া, মনমাতানো গন্ধমাখা স্বর্গীয় অনুভূতি। ‘স’-এ সীতাভোগ, ‘ম’-এ মিহিদানা ছাড়া আর তো কিছু শেখায়নি বর্ধমানের বর্ণপরিচয়!

Advertisement

পিনাকী বন্দ্যোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ২০ মার্চ ২০১৬ ০২:৫৪
Share:

বর্ধমানের কথা উঠলেই পত্রপাঠ নাম দু’টো জুড়ে দেওয়া বাঙালির বহু বছরের অভ্যাস। ওই নাম করতে করতেই তার মনে পড়ে ফুরফুরে সাদা আর গুঁড়ো গুঁড়ো হলুদরঙা, মুখে দিতে না দিতেই মিলিয়ে যাওয়া, মনমাতানো গন্ধমাখা স্বর্গীয় অনুভূতি। ‘স’-এ সীতাভোগ, ‘ম’-এ মিহিদানা ছাড়া আর তো কিছু শেখায়নি বর্ধমানের বর্ণপরিচয়!

Advertisement

দুই মিষ্টির জন্মকথা নিয়ে নানা গালগল্প ঘুরপাক খায় এই জেলায়। সে সবই এ বার ভারত সরকারের নথিতে ঠাঁই পাওয়ার অপেক্ষায়। বর্ধমানের সীতাভোগ-মিহিদানা নিয়ে যাবতীয় খুঁটিনাটি তথ্য জোগাড় করে কেন্দ্রের সংস্থা ‘জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন রেজিস্ট্রি’-র কাছে পেশ করেছে রাজ্য সরকার। ‘বর্ধমানের গর্ব’ দুই মিষ্টির জন্য ‘জিআই’ তকমার আর্জি জানিয়েছে তারা।

জিআই বা ‘জিওগ্রাফিক্যাল আইডেন্টিফিকেশন’ তকমা দেওয়ার অর্থ হল, কোনও একটি অঞ্চলের জনপ্রিয় পণ্যকে ভৌগোলিক ভাবে চিহ্নিত করা। এর আগে দার্জিলিঙের চা, মালদহের ক্ষীরসাপাতি-লক্ষ্মণভোগ আম, বিষ্ণুপুরের বালুচরী শাড়ি, জয়নগরের মোয়া এই স্বীকৃতি পেয়েছে। কোন পণ্য জিআই তকমা পাবে, তা ঠিক করে কেন্দ্রের ‘ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি অব ইন্ডিয়া’-র অন্তর্গত সংস্থা ‘জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন রেজিস্ট্রি’। তারাই রাজ্যের সীতাভোগ-মিহিদানা-সংক্রান্ত দাবি খতিয়ে দেখছে। রসগোল্লার জিআই তকমার দখল নিয়ে কাজিয়া বেধেছে বাংলা আর ওড়িশার মধ্যে। সীতাভোগ-মিহিদানা কিন্তু তেমন প্রতিযোগিতায় পড়েনি।

Advertisement

বাংলার বহু মিষ্টির জন্ম-কাহিনিতেই পাওয়া যায় রাজনীতি-ইতিহাসের অনুষঙ্গ। যেমন, বিশ শতকের গোড়ায় লর্ড কার্জনের বর্ধমান সফরের সঙ্গে কেউ কেউ সীতাভোগ-মিহিদানা সৃষ্টির যোগ খুঁজে পান। ১৯০৪ সালে বড়লাটের আপ্যায়নে বর্ধমানের মহারাজা বিজয় চাঁদ নাকি বিশেষ ধরনের মিষ্টি তৈরির বরাত দেন। কেউ কেউ আবার দাবি করেন, এরও বছর দুয়েক বাদে নিখিল বঙ্গ সম্মেলন উপলক্ষে মিহিদানা-সীতাভোগের জন্ম।

কার্জন-কাহিনিটিকেই ‘অভ্রান্ত’ বলে প্রচার করে কয়েক দশক আগে বর্ধমান শহরের অন্যতম মিষ্টি-স্রষ্টা ভৈরবচন্দ্র নাগ নিজেদের মিহিদানার রূপকার বলে দাবি করেছিলেন। তাঁর দোকান এখন আর নেই। তবে ওই দাবি নিয়ে বর্ধমানের মিহিদানা-রসিক মহলে সংশয় আছে। কারও কারও মতে, লর্ড কার্জনের

আপ্যায়নে সীতাভোগ-মিহিদানার আয়োজন হয়ে থাকলেও এ মিষ্টি আসলে তার চেয়েও পুরনো। তবে বর্ধমানের নামের সঙ্গেই যে সীতাভোগ-মিহিদানার অঙ্গাঙ্গী যোগ, তা নিয়ে দ্বিমত নেই। জেলায় চালের উৎপাদন প্রচুর। সম্ভবত তাতেই চালের গুঁড়ি-নির্ভর সীতাভোগ আর মিহিদানা তৈরিতে অ্যাডভান্টেজ পেয়েছে বর্ধমান।

সীতাভোগ অ্যান্ড মিহিদানা ট্রেডার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন-এর সহকারী সম্পাদক প্রমোদ সিংহ তাই আশায় আশায় আছেন। তাঁর কথায়, ‘‘বর্ধমানে শ’তিনেক দোকান সীতাভোগ-মিহিদানা তৈরি করে। জিআই ছাপ ও নির্দিষ্ট লোগো পেলে এই মিষ্টি বিদেশে রফতানিতেও সুবিধে হবে।’’ জিআই তকমা মিহিদানা-সীতাভোগের বিপণনে হাতিয়ার হবে বলে আশা সরকারি কর্তাদেরও। খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ দফতরের অন্যতম ডিরেক্টর জয়ন্তকুমার আইকতের মত, জিআই তকমা মিললে বর্ধমান পুর এলাকার মিহিদানা-সীতাভোগ স্রষ্টারা সকলেই লাভবান হবেন। বর্ধমানের নাম করে নিকৃষ্ট মানের সীতাভোগ-মিহিদানা বিক্রির অপচেষ্টাও রুখে দেওয়া যাবে।

তবে এই জেলারই ইতিহাসের গবেষক সর্বজিৎ যশ বলছেন, ‘‘বর্ধমান শহরে সীতাভোগ-মিহিদানার নানা কিসিমের শ্রেণিভেদ আছে। বিভিন্ন দোকানে ভাল, মাঝারি, খারাপ— সব ধরনের সীতাভোগ-মিহিদানার খোঁজ মিলবে।’’ এ দেশের খাবারের ইতিহাস নিয়ে গবেষণালব্ধ একটি গ্রন্থের প্রণেতা তথা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষিকা উৎসা রায়েরও মত, ‘‘আকছার দেখা যায়, বাংলার বেশ কিছু মিষ্টির সৃষ্টি ও প্রসারের সঙ্গে কোনও একটি জায়গার নাম ঐতিহাসিক ভাবে জড়িয়ে। কিন্তু তা বলে বর্ধমানের মিহিদানা বা শক্তিগড়ের ল্যাংচাই দুনিয়ার সেরা, তা বলা যায় না।’’

জিআই তকমা পাওয়ার পর যখন লোগো তৈরি হয়, তখন সচরাচর ব্যবসায়ীদের জন্য একটা গুণগত মাপকাঠি বেঁধে দেওয়াটাই রেওয়াজ। অর্থাৎ ওই মাপকাঠি পূরণ না করলে লোগো ব্যবহারের অনুমতি মিলবে না। কিন্তু বিশ্বের দরবারে সার্বিক ভাবে পণ্যের মান ধরে রাখাটাও এক গুরুদায়িত্ব। ধরা যাক, ছাপমারা দার্জিলিং চায়ের স্বাদও যদি পানসে হয়, তবে তাতে দেশের মুখই পুড়বে। মিষ্টির ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা অন্য রকম কিছু নয়।

মিহিদানাপ্রেমীরা আক্ষেপ করেন, সেই নুনের মতো মিহি, পোলাওয়ের মতো ঝরঝরে, খাঁটি ঘিয়ে সুরভিত কমলা-হলুদ দানা বর্ধমানে সব সময়ে সুলভ নয়। গোবিন্দভোগ চালের গুঁড়ো ও ছানা মিশিয়ে ‘নুডলস’-প্রতিম সীতাভোগেও সব সময়ে সেই কৌলীন্য পাওয়া যায় না। বর্ধমানের শতাব্দী-প্রাচীন গণেশ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের কর্তা প্রসেনজিৎ দত্তের আক্ষেপ, ‘‘সব মিষ্টির দোকান মোটেই উপকরণের গুণমানের পরোয়া করে না। ভাল ঘিয়ের বদলে সস্তার চাল ও ডালডা, কিংবা সীতাভোগে ছোলার ডালের বদলে খেসারি দিয়ে কেউ কেউ সহজে বাজিমাত করতে চায়।’’

কাজেই ভাবনা চলছে, বিভিন্ন দোকানে সীতাভোগ-মিহিদানার গুণমান নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা কী ভাবে করা যায়। ভাল সীতাভোগ-মিহিদানা বিরল হয়ে গেলে জিআই তকমা পেয়েও লাভ হবে না। ‘বর্ধমানের গর্ব’কে বিশ্বের দরবারে ছড়িয়ে দেওয়ার আগে গুণমান সুনিশ্চিত করাটা তাই ভীষণ জরুরি!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন