অসহিষ্ণুতা থেকে রেহাই নেই মা-সন্তান সম্পর্কেরও

দীর্ঘ দিন ধরে অসুস্থ বাবার সেবা করে ক্লান্ত তরুণী। বিসর্জন দিতে হয়েছে নিজের সব শখ-আহ্লাদ। সমস্ত রোজগার এবং চাকরির বাইরে বেঁচে থাকা সময়টুকু বাবার জন্যই নিবেদিত। উপায় খুঁজেছিলেন ‘স্লো পয়জনিং’-এর। যাতে ধীরে ধীরে মৃত্যু হয় বাবার।

Advertisement

তিয়াষ মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৯ জানুয়ারি ২০১৮ ০২:৪৩
Share:

আত্মীয়ের বাড়ি যাবেন বলে বৃদ্ধা মাকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়েছিলেন ছেলে। অচেনা স্টেশনের ভিড়ে ছেড়ে দেন মাকে। বাড়ির ফোন নম্বর, ঠিকানা— কিছুই সড়গড় ছিল না, তাই ঘরে ফেরা হয়নি বৃদ্ধার।

Advertisement

দীর্ঘ দিন ধরে অসুস্থ বাবার সেবা করে ক্লান্ত তরুণী। বিসর্জন দিতে হয়েছে নিজের সব শখ-আহ্লাদ। সমস্ত রোজগার এবং চাকরির বাইরে বেঁচে থাকা সময়টুকু বাবার জন্যই নিবেদিত। উপায় খুঁজেছিলেন ‘স্লো পয়জনিং’-এর। যাতে ধীরে ধীরে মৃত্যু হয় বাবার।

ঘটনাগুলি চমকানোর মতো হলেও খুব অচেনা নয়। আমাদের আশপাশেই ঘটেছে এমনটা। এই বিকৃতি এবং অসহিষ্ণুতার শেষতম নজিরটি সম্প্রতি তৈরি হল গুজরাতের রাজকোটে। অভিযোগ, অসুস্থ মাকে ছাদ থেকে ঠেলে ফেলে দিয়েছে ছেলে। শুধু তা-ই নয়, মাস তিনেক আগে এই কাণ্ড ঘটিয়ে অভিযুক্ত সন্দীপ নাথওয়ানি দাবি করে, মায়ের মানসিক অসুস্থতা ছিল, তাই তিনি আত্মহত্যা করেছেন। চলতি মাসের পাঁচ তারিখে প্রকৃত ঘটনা জানতে পারেন তদন্তকারীরা। লাগাতার জেরায় বেরিয়ে আসে নিষ্ঠুর এবং শিউরে ওঠার মতো সত্যি। সে
পুলিশকে বলে, ‘‘মায়ের অসুস্থতা নিয়ে বিরক্ত ছিলাম৷ বাড়িতে অশান্তিও লেগে থাকত৷ উপায় না দেখে মাকে ছাদ থেকে ফেলে দিই !’’ সন্দীপের বিরুদ্ধে খুনের মামলা রুজু হয়েছে৷

Advertisement

বহু দিন ধরে অসুস্থ ছিলেন ৬৪ বছরের জয়শ্রীবেন৷ এ নিয়ে বেশ বিরক্ত ছিল তাঁর ছেলে, রাজকোটের বাসিন্দা, পেশায় অধ্যাপক, ৩৬ বছরের সন্দীপ৷ টাকা খরচ ছাড়াও, মায়ের অসুস্থতাকে কেন্দ্র করে নিত্য অশান্তি লেগেই থাকত স্ত্রীয়ের সঙ্গে৷ শেষমেশ সব অশান্তি, ঝামেলায় ইতি টানতে, মাকেই পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার ছক কষে সে। অভিযোগ, সেই ছক অনুযায়ী গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর, সকালবেলা সূর্য প্রণামের নাম করে ছাদে উঠে, সেখান থেকে মাকে ঠেলে ফেলে দেয় সন্দীপ! ঘটনাটির সিসিটিভি ফুটেজ ইতিমধ্যেই ভাইরাল হয়ে গিয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। নিন্দায় ফেটে পড়েছে নেট-জগৎ।

সমাজতত্ত্বের শিক্ষক প্রশান্ত রায় জানাচ্ছেন, বৃদ্ধ বাবা অথবা মা-কে ভিড়ে ছেড়ে দিয়ে আসা খুব বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বিরল হলেও নতুন নয় মেরে ফেলাও। তাঁর মতে এই প্রবণতার কারণ হচ্ছে, বিরক্তি এবং হতাশা। যদিও কোনও কারণ দেখিয়েই এই ঘটনাগুলির সপক্ষে যুক্তি দাঁড় করানো যায় না, তবু একটা সময় পরে ‘টানতে না পেরে’ চরমতম সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে সন্তান। ‘‘কিছু উৎপাদন করছে না, কিন্তু তার পিছনে অনেক খরচ হয়ে যাচ্ছে— এ রকম ‘নন-ইকোনমিক্যাল’ একটা অবস্থা থেকেই বৃদ্ধ মা-বাবাকে শেষ করে দেওয়ার প্রবণতা জন্মায়। সন্তান মনে করে, মা-বাবাকে আর বাঁচিয়ে রাখার দরকার নেই, তাঁদের বেঁচে থাকার যোগ্যতাও নেই,’’ বললেন তিনি।

এর সঙ্গে অনেক সময়ে সম্পত্তি প্রাপ্তির ব্যাপারও জড়িয়ে থাকে বলে মনে করছেন অনেকে। কেউ মারা গেলে হয়তো বাড়ির অংশ পাওয়া যাবে, টাকা পাওয়া যাবে। এই পাওয়ার লোভে যারা খুন করছে, তারা সেটাই স্বাভাবিক ভাবছে। লাভের নেশাটা এক সময়ে এতই তীব্র হয়ে যায় যে, সব বোধ লোপ পায়।

দক্ষিণ কলকাতার এক প্রৌঢ় নিজের তরুণ বয়সের এক ঘটনার কথা বলছিলেন। দীর্ঘ দিন ধরে বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনা করে, তার দিন কুড়ি আগে অসুস্থ হয়ে পড়েন অশীতিপর মা। পরিস্থিতি এমনই দাঁড়ায়, অসুস্থ মাকে ফেলে বেড়াতে যাওয়া যাবে না। অথচ বেড়ানোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেক পরিকল্পনা, টাকাপয়সা। ‘‘তখন কয়েক বার মনে হয়েছিল, মা মারা গেলেই ভাল হয়! আমাদের যাওয়াটা
হয়,’’ স্বীকার করলেন তিনি। প্রশান্তবাবু বলছেন, ‘‘মুহূর্তের বিরক্তিতে এই মনে হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু মানবিকতা ও যুক্তি দিয়ে সেটা প্রশমিত হয়। তা না হলেই আসে বিকৃতি। ঘটে যায় চূড়ান্ত অপরাধ।’’

কয়েক বছর আগের বলিউডের বাগবান ছবি দেখিয়েছিল, বাবা-মায়ের দায়িত্ব কে নেবে তাই নিয়ে চূড়ান্ত সমস্যা তৈরি হয় সন্তানদের মধ্যে। প্রত্যেকের পরিবারের মধ্যে রীতিমতো অশান্তির ছবি দেখা গিয়েছিল। দেখা গিয়েছিল অবহেলার চূড়ান্ত নিদর্শন। খাওয়া-শোওয়া নিয়েও অসুবিধায় পড়তে হয়েছিল ছবির প্রৌঢ় বাবা-মাকে। মনোরোগের চিকিৎসক অনিরুদ্ধ দেব জানাচ্ছেন, আসল সমস্যা এই অবহেলাই। তিনি জানান, অবহেলার নানা ধরন আছে। যেমন, বাবা-মাকে যতটা দেখাশোনা করা উচিত, ততটা না করা। যতটা সময় দেওয়া উচিত, ততটা না দেওয়া। হয়তো স্বেচ্ছায় নয়, পরিস্থিতির চাপেই অবহেলিত হন তাঁরা। আর এই অবহেলারই আর একটু উপরের স্তর কোথাও ছেড়ে চলে আসা। আর চরম স্তর হল মেরে ফেলা। রাজকোটের ঘটনাটি নিয়ে তাঁর পর্যবেক্ষণ, ‘‘নিশ্চয়ই কোনও রকমের লাভের সম্ভাবনা ছিল। সেটা সম্পত্তি হতে পারে, নিজেকে জটিলতা থেকে মুক্তি দেওয়াও হতে পারে। কিন্তু এত নৃশংস হল কেন পদ্ধতিটা, সেটাও দেখার,’’ বললেন তিনি।

চিত্র পরিচালক শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় তুলে ধরলেন সম্পূর্ণ অন্য একটা দিক। তাঁর মতে, কাজটি অত্যন্ত মর্মান্তিক। কিন্তু এমন একটা কাজের পিছনে যতটা না অভিযুক্ত সন্তান একক ভাবে দায়ী, তার চেয়ে বড় দায় এই আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি। তিনি বললেন, ‘‘এই সমাজ ব্যবস্থায় বয়স্কদের ন্যূনতম পেনশন পাওয়ার পদ্ধতিটুকুও মসৃণ নয়। তরুণদের আয়ের পথ ক্রমশ সঙ্কীর্ণ হচ্ছে এবং অনিশ্চয়তার পথ প্রশস্ত হচ্ছে। এই অবস্থায় অসুস্থ মা-বাবার প্রতি যত্ন বা মমতার চেয়েও বেশি তৈরি হয় দায়বদ্ধতা। আর তাঁর থেকে প্রাপ্তির জায়গাটা যখন শূন্য, তখন তা তিনি বোঝা। বোঝা ঝেড়ে ফেলতে চাওয়া মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন