ভোট না-দিয়ে হাতকাটা বোনকে নিয়ে অন্য লড়াই

স্যাঁতসেঁতে ঘরে ভাল করে আলো ঢোকে না। টালির ছাদ। একটা ঘরকেই ভাগ করে রান্নার জায়গা। ভাঙাচোরা শৌচালয়। এর মধ্যেই বোনকে নিয়ে টিকে থাকার লড়াই ঝুমার।

Advertisement

সুনন্দ ঘোষ

কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ মে ২০১৯ ০৩:৩৭
Share:

জয়ন্তী মজুমদার এবং তাঁর দিদি ঝুমা। ছবি: স্নেহাশিস ভট্টাচার্য।

গণতন্ত্রের বৃহত্তম যজ্ঞে নিমন্ত্রণ নেই তাঁদের। ‘‘ভেবেছিলাম, এ বার যিনি ভোট চাইতে আসবেন, তাঁকে বলব চাকরির কথা। কিন্তু কেউ আসেননি। আমরা ভোট দিতেও যাব না,’’ বললেন বছর তিরিশের ঝুমা। শুধু হাতকাটা বোনের জন্য একটা চাকরির ব্যবস্থা করতে বা বোনের বিয়ে দিতে পারলেই নিশ্চিন্ত হতে পারেন তিনি।

Advertisement

স্যাঁতসেঁতে ঘরে ভাল করে আলো ঢোকে না। টালির ছাদ। একটা ঘরকেই ভাগ করে রান্নার জায়গা। ভাঙাচোরা শৌচালয়। এর মধ্যেই বোনকে নিয়ে টিকে থাকার লড়াই ঝুমার।

না, কোনও গ্রাম নয়। কলকাতাই তাঁদের ঠিকানা। কলকাতাই তাঁদের লড়াইয়ের মাঠ। সোদপুর থেকে ঘোলা যাওয়ার পথে তাঁদের বাড়ির আশপাশে হাজির যাবতীয় শহুরে বিলাসিতা। তারই মধ্যে ‘ভাল দিন’-এর আশায় দুই বোনের যুদ্ধ। ছোট বোন জয়ন্তী মজুমদারের বয়স ২৭। বাঁ হাতের কব্জির কাছ থেকে কাটা। রাজ্য সরকারের অধীন সরস্বতী প্রেসে কাজ করতে করতে দুর্ঘটনা ঘটে ২০১২ সালে। সেই থেকে বাড়িতে বসে। এককালীন ক্ষতিপূরণটুকুও জোটেনি। যে-ঠিকাদারের অধীনে কাজ করতেন, সেই বিশ্বজিৎ বিশ্বাস এখনও টাকা দিয়ে সাহায্য করেন। কিন্তু সরকারি সাহায্য মেলেনি। সরস্বতী প্রেসের এমডি সুবোধ মজুমদারের কথায়, ‘‘ঠিকা কর্মীদের জন্য সাহায্যের কোনও সংস্থান নেই সরকারের।’’

Advertisement

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

দিদি ঝুমা সর্বক্ষণের সঙ্গী। বিয়ে করে কিছু দিনের মধ্যে শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে চলে আসেন তিনি। বাবা-মায়ের মৃত্যুর পরে জয়ন্তীর সঙ্গেই তাঁর সংসার। জয়ন্তীর দুর্ঘটনার পরে বেশ কিছু দিন পুরোপুরি ঝুমার উপরেই নির্ভরশীল ছিলেন জয়ন্তী। ঝুমা গেঞ্জি কারখানায় কাজ করতেন। দুই বোনের সংসার চলে যাচ্ছিল। কিন্তু পুলিশে চাকরি দেবে বলে এক ব্যক্তির পাতা ফাঁদে পা দিয়ে সেই চাকরি ছাড়েন ঝুমা। আপাতত দু’জনেই বেকার। বিশ্বজিৎবাবুর পাঠানো টাকায় কোনও মতে দিন গুজরান হচ্ছে।

ঝুমার অভিযোগ, ‘‘বোনের জন্য প্রতিবন্ধী সার্টিফিকেট করিয়েছি। মুখ্যমন্ত্রীর কাছে চিঠি পাঠিয়েছি। বহু জায়গায় দরবার করেছি। কিন্তু কেউ চাকরি দেয়নি। বোনের বিয়ে দেব বলে সম্বন্ধের চেষ্টাও করেছি। কিন্তু বাঁ হাত কব্জি থেকে কাটা বলে কেউ বিয়ে করতে রাজি হচ্ছে না। অথচ ও এখন সব ধরনের কাজ করতে পারে।’’

ঝুমারা ছয় বোন। বাবা সুধন্য মারা যান ২০০২ সালে। মা হেমলতা চলে যান ২০০৮-এ। তত দিনে উপরের চার বোনের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। বিয়ে করে আবার বাপের বাড়িতে ফিরে এসেছেন ঝুমা। টাকার অভাবে নবম শ্রেণির বেশি পড়া হয়নি দুই বোনের। স্থানীয় কাউন্সিলরের আশ্বাস, ২৫ হাজার টাকা দিলে সরকার পাকা বাড়ি বানিয়ে দেবে। কিন্তু সেই ২৫ হাজার টাকা দেওয়ার সামর্থ্য নেই দুই বোনের।

জয়ন্তী সরস্বতী প্রেসে চাকরিতে ঢোকেন ২০০৮ সালে। বললেন, ‘‘২০১২-র ১৮ ফেব্রুয়ারি, শনিবার সকাল সাড়ে ১০টার ঘটনা। বই বাঁধাই করতে গিয়ে মেশিনে কেটে যায় হাতের পাঁচ আঙুল। হাসপাতালে কব্জি থেকে হাত বাদ দিয়ে দেয়।’’

বিশ্বজিৎবাবুর আফসোস, ‘‘সেই সময় জয়ন্তী-সহ আমার কয়েক জন কর্মীর ইএসআই ও পিএফ করা ছিল না। তাই দুর্ঘটনার পরে ক্ষতিপূরণ পায়নি জয়ন্তী। ভুল আমারই। আমার কাছে ১০ লক্ষ টাকা চেয়েছিল ও। তা দেওয়ার সামর্থ্য আমার নেই। তাই কাজ করলে ও যে-টাকা পেত, সেটা প্রতি সপ্তাহে পাঠিয়ে দিই।’’

কিন্তু কত দিন চলবে এ ভাবে?

বিশ্বজিৎবাবু বললেন, ‘‘জানি না!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন