অস্ত্রোপচার-পরবর্তী পরিচর্যাতেই কি পিছিয়ে রয়েছে এই রাজ্য

প্রতিস্থাপন সফল হলেও থেকে যায় ঝুঁকি

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে এটাই মনে হয়, এ শহরে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে পারলে যেটা প্রায় নিখরচায় হয়ে যেত, সেখানে অনেকটাই বেশি খরচ করতে হয়েছে আমাদের। কিন্তু সব মিলিয়ে যে পরিষেবা পেয়েছি, তাতে খরচ নিয়ে আফশোস হয়নি। প্রতিস্থাপন পরবর্তী সাবধানতায় হয়তো আমাদের রাজ্যের আরও কিছুটা পথ এগোনো বাকি।

Advertisement

শৌভিক দে

শেষ আপডেট: ১৫ নভেম্বর ২০১৭ ০২:২০
Share:

অস্ত্রোপচারের পরে হায়দরাবাদের হাসপাতালে শুক্লা দে (বাঁ দিকে)। সুস্থ হওয়ার পরে (ডান দিকে)। নিজস্ব চিত্র

ওটি থেকে ডাক্তারবাবু বেরোনোর পর অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম কাঙ্ক্ষিত শব্দবন্ধটার, ‘অপারেশন সাকসেসফুল’। কিন্তু সেটা বললেন না উনি, অস্ত্রোপচার সম্পূর্ণ নির্বিঘ্নে মেটার পরেও। বললেন, অস্ত্রোপচার ৭৫ শতাংশ সফল। জানালেন, বাকিটা তখনই সফল হবে, যখন ‘পোস্ট অপারেটিভ পিরিয়ড’-এর জটিলতার ঝুঁকিগুলো সম্পূর্ণ রকম ভাবে দূর হয়েছে বলে মনে করা হবে।

Advertisement

২০১৬ সালের জুন মাসে উত্তর কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে প্রথম ধরা পড়ল মায়ের অসুখটা। ‘সিরোসিস অব লিভার’। আমার মা, ৫২ বছরের শুক্লা দে। সল্টলেকের বাসিন্দা। চিকিৎসকেরা মাকে দেখে, পরীক্ষা করে জানান, অস্ত্রোপচার এই মুহূর্তে প্রয়োজন নেই। ওষুধ খেয়ে মা সুস্থ থাকবেন অনেক বছর। কিন্তু মায়ের অবস্থার যে ভাবে অবনতি হচ্ছিল, যে-ভাবে কষ্ট পাচ্ছিলেন, খুব একটা ভরসা পাচ্ছিলাম না।

নভেম্বর মাসে মাকে নিয়ে যাই হায়দরাবাদের একটি গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজি কেন্দ্রে। সেখানে চিকিৎসকেরা সম্পূর্ণ উল্টো কথা বললেন। আমরা পড়লাম আতান্তরে। শুনলাম, সময় নেই একেবারেই। মেরেকেটে বছর খানেক। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব লিভার প্রতিস্থাপন প্রয়োজন। ওষুধে সারার কোনও সম্ভাবনাই নেই! তার পর থেকেই শুরু ছুটোছুটি। কলকাতায় ফিরে সব জায়গায় খোঁজখবর নেওয়া শুরু হল। এই বছরের মার্চের গোড়ায় পিজি-তে নাম লেখানো গেল। কবে কী হতে পারে, কোনও ভরসা মেলেনি। সার্জন বলেছিলেন, রোগী প্রতিস্থাপনের জন্য তৈরি। কিন্তু লিভার নেই।

Advertisement

আমরা ভরসা রাখতে না-পেরে ১২ এপ্রিলে হায়দরাবাদের একটি হাসপাতালে পৌঁছই মাকে নিয়ে। ওঁরা সব রকম পরীক্ষা করে জানান, তিন থেকে ছ’মাস সময় লাগতে পারে। অপেক্ষা করা ছা়ড়া কোনও বিকল্প ছিল না আমাদের কাছে। আমাদের মতো মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য ওই হাসপাতালটিই সব চেয়ে সুবিধাজনক, এ কথাই বলেছিলেন বিশেষজ্ঞেরা।

মাসখানেক পরেই, ২৭ মে সন্ধ্যায় হঠাৎ ফোন। লিভার মিলেছে। আধ ঘণ্টার মধ্যে জানাতে হবে, পরের দিন অর্থাৎ ২৮ তারিখ সকালে পৌঁছতে পারব কি না। জমা করতে হবে টাকাও। ঝড়ের গতিতে সব ব্যবস্থা হল। ২৮ তারিখ সকালে পৌঁছে গেলাম হায়দরাবাদ, ভর্তি করে নেওয়া হল মাকে। আমরা পরে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, এত তাড়াতাড়ি কী করে ব্যবস্থা হল লিভারের। জেনেছিলাম, দাতা ও লিভার প্রতিস্থাপনের অপেক্ষায় থাকা রোগীর হিসেব সরকারি খাতায় নিয়ম মেনে রাখা হয়। চাইলেও কেউ লাইন টপকে যেতে পারেন না। দাতার সংখ্যাও অনেক বেশি।

ওই দিনই দুপুর তিনটেয় অস্ত্রোপচার শুরু হয়ে গেল। মাঝ পথে সার্জন টম চেরিয়ান নিজে বেরিয়ে এসে আশ্বস্ত করে গেলেন, সব কিছু ঠিকঠাক চলছে। ভয়ের কারণ নেই। রাত সাড়ে বারোটায় অস্ত্রোপচার শেষ হল।

এর পরেই শুরু রোগীর নিয়মিত পরীক্ষা, কাউন্সেলিং। ২৪ ঘণ্টা কড়া নজর রাখতেন নার্স। ১৪ জন চিকিৎসকের একটা দল দিনে একাধিক বার করে সব রকমের পরীক্ষা করে যেতেন। এ ছাড়াও আলাদা একটা ঘরে বসে রোগী ও পরিবারের যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর দিতেন ডাক্তার নিজে। প্রতি দিন রোগী ঠিক কী অবস্থায় আছেন, কতটা উন্নতি হল, এ সব জানানোর পাশাপাশি আমাদের সমস্ত রকম প্রশ্নের উত্তর দিতেন রোজ। স্বাভাবিক ভাবেই অনেক অসঙ্গত প্রশ্ন করে ফেলতাম আমরা, একটা বারের জন্যও বিরক্ত হতে দেখিনি ওঁকে।

পাঁচ দিন পর কাঙ্ক্ষিত উন্নতি দেখে কেবিনে পাঠানো হল মাকে। এর পরের দিনই হঠাৎ বিপদ। কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হল মায়ের। চিকিৎসক এসে পৌঁছনোর আগেই সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিলেন সেবিকা। সেই মুহূর্তে ইলেকট্রিক শক দেওয়ার প্রয়োজন ছিল, সেটাও করা হল। সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া হল আইসিইউ, চলে এল হার্ট স্পেশ্যালিস্টের দল। এই গোটা সময়টায় নির্দিষ্ট সময় অন্তর নিজে থেকেই সব তথ্য জানাতেন চিকিৎসক নিজে।

সে সময় মায়ের শরীরটা ফুলে গিয়েছিল, নতুন চ্যানেল করার শিরা মিলছিল না। হাতে, গলায় আগেই করা হয়ে গিয়েছিল। ডাক্তারবাবু নিজে বসে থেকে নতুন চ্যানেলটা করান। এখানে তো আমরা প্রায়ই দেখি, শিক্ষানবিশদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয় এই চ্যানেল করার কাজ। রক্তারক্তিও ঘটে হামেশাই। ওখানে ওই ঝুঁকিটুকুও নেন না চিকিৎসক।

কুড়ি দিন পর ছাড়া পেলেন মা। দেড় মাস থাকতে হয়েছিল হায়দরাবাদেই। যে বাড়িটা আমরা ভাড়া নিয়েছিলাম, সেখানে হাসপাতাল কর্মীরা নিজে গিয়ে ব্যবস্থা করে আসেন, যাতে ঘর থেকে সমস্ত রকম সংক্রমণের আশঙ্কা দূর হয়। পইপই করে বুঝিয়ে দেন, ছ’মাস খুব বিপজ্জনক সময়। কত রকমের ঝুঁকি আসতে পারে এই সময়ে। বারবার মনে করিয়ে দেন, প্রতিস্থাপনের সময় যত না মৃত্যু হয়, তার চেয়ে বেশি হয় অস্ত্রোপচার পরবর্তী সংক্রমণে। খাবার, ওষুধ এই সব কিছুর বিস্তারিত বিধি আমাদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কোন ওষুধ কখন খাওয়াতে হবে, এটুকুই শুধু নয়, কেন ওষুধের কী কাজ, খাওয়াতে ভুল হলে কী হতে পারে, এই সমস্ত কিছুও আমরা শিখে ফিরেছিলাম। এখন দেড় মাস অন্তর চিকিৎসক এখানে আসেন, সেখানে নিয়ে গিয়ে চেক আপ করাই মাকে। এ ছাড়াও যে কোনও সময়, যে কোনও প্রয়োজনে সরাসরি যোগাযোগ করা যায় হাসপাতালে।

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে এটাই মনে হয়, এ শহরে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে পারলে যেটা প্রায় নিখরচায় হয়ে যেত, সেখানে অনেকটাই বেশি খরচ করতে হয়েছে আমাদের। কিন্তু সব মিলিয়ে যে পরিষেবা পেয়েছি, তাতে খরচ নিয়ে আফশোস হয়নি। প্রতিস্থাপন পরবর্তী সাবধানতায় হয়তো আমাদের রাজ্যের আরও কিছুটা পথ এগোনো বাকি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন