গামছায় বেঁধে নিয়ে যাওয়া কলাইয়ের রুটি এক সঙ্গে পা ছড়িয়ে বসে ভাগ করে খাওয়া ছিল চেনা রেওয়াজ। তেল আর কাঁচা লঙ্কার ভাগাভাগিতে সেই কেঠো রুটি নরম হয়ে উঠত সীমান্তের উর্দির সঙ্গে!
শুধু এ বিএসএফ নয়, ও পারের মানুষের সঙ্গেও চেনা লেনদেন ছিল দু’বাড়ির মতো সহজ-স্বাভাবিক। রানিনগরের বামনাবাদ গ্রামের মৎস্যজীবী মহিদুল ইসলাম পদ্মা পাড়ে বসে ছিলেন সে সব দিনের কথার ঝুড়ি নিয়ে। মহিদুল একা নন, জলঙ্গি রানিনগর, রানিতলা, ভগবানগোলার হাজার হাজার মৎস্যজীবী সেই পুরনো অতীত আঁকড়েই এখনও চেয়ে থাকেন পদ্মার দিকে। তাঁদেরই এক জন বলছেন, ‘‘পদ্মার বুকে দিন রাত সমান করে নিশ্চিন্তে ভেসে থাকাই ছিল জীবন।’’ ঝুড়ি ভর্তি ইলিশের সঙ্গে মাচার লাউয়ের বদল, এখন হারানো অতীত।
পদ্মার শাখা নদীর যে দিকে চোখ যায় ধুধু বালুচর। সেই চরে উল্টে থাকা নৌকায় হেলান দিয়ে অধীর মণ্ডল বলেন, ‘‘সে সব কথা বলতে চোখে জল আসে, বাবা-কাকার সঙ্গে পদ্মায় মাছ ধরে ফিরতাম ঝুড়িভর্তি মাছ নিয়ে। সেই আনন্দ এখনও চোখ বুজলে দেখতে পাই।’’ তাঁদের স্মৃতিতে— দেশভাগ হলেও সীমান্তটা তখনও ভাগ হয়নি! বিএসএফ ছিল বন্ধুর মতো। মাঝে মাঝে মাছ ধরতে ধরতে মিলেমিশে যেত এ পার-ওপার। এমনকি, নিজেদের খাবারটাও অনেকদিন ভাগ করে খেয়েছেন তাঁরা বাংলাদেশি ধীবরের সঙ্গে। চোখের সামনেই সেই পদ্মা বদলে গিয়েছে। যেমন বদলে গিয়েছে সীমান্তের কড়াকড়ি। এখন শুখা মরসুমে পদ্মায় জলের অভাব আর সীমান্তের ধারে ভিড়তে গেলে বিএসএফের চোখরাঙানি। বলছিলেন বছর ষাটের মৎস্যজীবী অনিমেষ হালদার। যাঁদের চোখের সামনে বদলে গিয়েছে পদ্মা, যাঁরা ক’দিন আগেও সীমান্তের ওপারের গ্রামটাকে মনে করতেন পড়শি, তাঁদের কাছে এখন পদ্মায় মাছ ধরতে যাওয়া প্রায় ভিনদেশে যাওয়ার সমান। লাইন দিয়ে বসে ভোটার কার্ড, মৎস্যজীবী কার্ড জমা, তার পর অনুমতি। মৎস্যজীবীদের দাবি, বছর কয়েক আগেও বাংলাদেশের মিরগঞ্জ- চারঘাট-ইসবপুর-সাহাপুর-কুঠিবাড়ি এলাকায় মাছ ধরায় বাধা ছিল না। অনেক সময় ওপারের ক্যাম্পে গিয়ে জল খেয়ে এসেছেন তাঁরা। ও পারের মৎস্যজীবীরাও এ দিকের ক্যাম্পে এসে মাছ ধরে গিয়েছে বিনা বাধায়। পদ্মায় মাছ কমে যাওয়া আর সীমান্তরক্ষীদের কড়াকড়িতে সময়ে মাছ ধরতে না পারা। সঙ্গে কাপড়া জাল বা কারেন্ট জালের জন্য ছোট মাছ, মাছের ডিম নষ্ট হচ্ছে পদ্মায়।
হারানো সেই পদ্মা যেন সত্যিই শীতল হয়ে এসেছে ধীবরকুলের কাছে।