অন্য পুজো
Pingla

Artist: জীবন যুদ্ধে মণির আভা

পাড়ায় ঢি ঢি পড়ে। মুসলমানের মেয়ের দুগ্গাপুজো নিয়ে অত আদিখ্যাতা কেন বাপু! মেয়ে অবশ্য ততক্ষণে গাঁয়ের ঠাকুরদালানে।

Advertisement

দেবাঞ্জনা ভট্টাচার্য

কলকাতা শেষ আপডেট: ১১ অক্টোবর ২০২১ ০৬:৩৯
Share:

পটিয়সী: মণিমালা চিত্রকর ও তাঁর দুর্গার পট। ছবি: কিংশুক আইচ

ভরদুপুরে বিটিটা গেল কই...

Advertisement

রোদে ধুয়ে যাচ্ছে মাঠ-ঘাট। আকাশে আশ্বিনের আলো। কাশ, শিউলি।

তবে প্রকৃতি ছাপিয়েও একরত্তি মেয়েটাকে বেশি টানে প্রাক্‌-পুজোর কুমোরপাড়া। মাটির তাল, রং-বার্নিশের গন্ধে ডুবে থাকে কচি প্রাণ। ডাগর চোখে তিল তিল করে মৃন্ময়ীর চিন্ময়ী হয়ে ওঠা দেখে সে।

Advertisement

পাড়ায় ঢি ঢি পড়ে। মুসলমানের মেয়ের দুগ্গাপুজো নিয়ে অত আদিখ্যাতা কেন বাপু! মেয়ে অবশ্য ততক্ষণে গাঁয়ের ঠাকুরদালানে। কখনও তার কপালে যজ্ঞের টিপ, কখনও প্রতিমার পায়ের সিঁদুর। পুজো-স্মৃতিতে ডুব দিলে বছর সাতচল্লিশের মণিমালা যেন সটান সাত। চনমনিয়ে ওঠে কিশোরীবেলার কথা।

মণিমালা চিত্রকর। পিংলার পটের গ্রাম নয়ার খ্যাতকীর্তি শিল্পী। যেমন আঁকা, তেমনই গানের গলা। রাজ্য পুরস্কার, ইন্দিরা গাঁধী রাষ্ট্রীয় মানব সংগ্রহালয়ের ‘জীবনকৃতি সম্মান’, তার পর দ্য টেলিগ্রাফ অ্যাকাডেমিক ট্যালেন্ট সার্চের ‘লেজেন্ডারি পটচিত্রকর’ পুরস্কার— ঝুলিতে মণি-মাণিক্য নেহাত কম নয়। বস্টন, অকল্যান্ড, তাইল্যান্ড— পটযাত্রার পথও সুদূর বিস্তৃত। তবে দিনবদলের যাত্রাপথটা মসৃণ নয় মোটেই। পাতালকন্যা মণিমালার শাপমুক্তির মতোই সে যেন জীবন্ত রূপকথা।

‘‘ঘরশত্রুদের সঙ্গেই তো লড়লাম চিরটাকাল’’— বলছেন মণিমালা। নিজের বাড়ি, মামাবাড়ি পটশিল্পের চর্চা ছিল উভয়ত। দাদু বাণেশ্বর চিত্রকর মস্ত পটশিল্পী। জ্ঞান হওয়া ইস্তক রং, তুলি, কাপড়ের ভাঁজে জীবনের আঁকিবুঁকি দেখেছেন। বলেন, ‘‘পটিদার বাড়ির মেয়ে বলেই বোধহয় ঠাকুর গড়া ও ভাবে টানত। হাঁ করে দেখতাম, এক তাল মাটি কেমন মায়ের মুখে বদলে যায়। টানা টানা চোখ, ত্রিনয়নের তেজ— সে রূপের ছটাই আলাদা।’’

তবে ছোট্ট মণির পট আঁকায় নিষেধ ছিল। ‘‘রং-তুলি ধরতেই দিত না। আমি ছুট্টে মাঠে পালাতাম। হাতের মুঠোয় এক ফালি কাপড় আর রং। ওইগুলো ছাড়িনি কক্ষণও।’’— বলেন অধুনা পট-গরবিনী।

বাড়িতে যে শিল্পের সিঞ্চন, তাতেই কি না বারণ?

‘‘আরে বাবা, মেয়ে না! মেয়ে সন্তান পট আঁকবে, গান বাঁধবে, পট নিয়ে এ দিক-সে দিক ঘুরে বেড়াবে— এ সব লোকে তখন ভাবতেও পারত না।’’ মণিমালা তখন অনর্গল। তেরোয় পড়তে না পড়তেই বিয়ে। স্বামীও পটশিল্পী। তবে ধাত সেই এক। তাই আঁকায় ছাড়পত্র মেলেনি শ্বশুরঘরেও। কিন্তু মণির জেদ যে দুগ্গার তেজের মতোই অফুরান। রাত জেগে, লুকিয়ে চলত পট আঁকা। স্বামী জল ঢেলে সব ছারখার করে দিত। দমত না মেয়েটা। সবটুকু শক্তি সঁপে দিত কাপড়ের ক্যানভাস আর রঙের বুননে। ঘরকন্না, ছ’-ছ’টা ছেলেমেয়ে সামলে আর পদে পদে প্রতিরোধ যুঝেই চলত লড়াই।

তার পর পটের মুহূর্তেরা বেড়েছে। লড়াইও কঠিন হয়েছে আরও। ‘‘গাঁয়ে ওরা বিচারসভা বসাল। বলল, পট নিয়ে বাইরে গেলে, সেখানে রাত কাটালে আমার বদনাম হবে। স্বামীর গায়েও ছিটে লাগবে’’—মণিমালা বলে চলেন, ‘‘ভাবলাম, এ বার একটা সিদ্ধান্ত নিতেই হয়। সালিশিতে বলেছিলাম, তবে স্বামীকেই ছেড়ে দিচ্ছি। কারণ, পট আমি ছাড়তে পারব না।’’ আর কোনও পিছুটান রাখেননি। সব ছেলেমেয়েকে সঙ্গে নিয়েই আলাদা হয়েছেন। বড় ছেলেটার বয়স তখন ১৪ আর ছোট মেয়েটা সবে সাত। মণি বলছেন, ‘‘আসলে মায়েদের শক্তিই আলাদা। জগজ্জননী যেমন সন্তানদের সঙ্গে নিয়েই অসুর বধ করেন,
আমিও তো ছেলেমেয়েগুলোর মুখ চেয়েই লড়লাম।’’

গত বিশটা বছর মণি লড়েছেন, গড়েছেন নিজেকে। একা মেয়ে হিসেবে পটের কাজ যখন শুরু করেন, তখন এলাকার মেয়ে-বউরাই মুখ বেঁকিয়েছিল। আড়ালে-আবডালে নয়, কটূ কথা শুনতে হয়েছে মুখের ওপরে। পরে অবশ্য তাঁদেরই অনেককে মণিদি শিখিয়ে পড়িয়ে নিয়েছেন, দেখিয়েছেন উপার্জনের পথ। মণিমালার পটের গানেও মেয়েদের স্বাবলম্বনের কথা। স্বসহায়ক দলের জন্য তাঁর গান— ‘গতর খাটিয়ে টাকা করিব রোজগার/পুরুষের কাছে আমরা পাতব না
কো হাত’।

নিজে লড়েছেন বলেই বোধহয় মেয়েদের লড়াই বড্ড টানে শিল্পী মণিকে। তাই দুর্গার পট, কৃষ্ণের পট ছাপিয়ে কখনও তাঁর ছবি আর গানের বোলে প্রাণ পান কল্পনা চাওলা, কখনও রং-তুলি-কলমের নির্ঘোষ মেয়ে পাচার আর পণপ্রথার বিরুদ্ধে। এই এখন যেমন মণিমালার হৃদি তোলপাড় তালিব-ভূমে আফগান কন্যার যন্ত্রণায়। মণিদি বলছেন, ‘‘সব দেশেই আসলে মেয়েদের বড্ড জ্বালা। তার এগোনোর রাস্তাও যে হতে হবে ছকে বাঁধা। ছক ভাঙলেই পায়ে বেড়ি, পথে কাঁটা।’’

কিন্তু মণি তো সে বেড়ি ভেঙেছেন? উপড়ে ফেলেছেন কাঁটা?

জবাব আসে, ‘‘অনেকটাই পেরেছি। ছেলেমেয়েদের যতটা পেরেছি লেখাপড়া শিখিয়েছি। পটটাও শিখেছে ওরা। তবে কষ্ট একটাই।, পটের মূল ধারাটা মরে যাচ্ছে।’’ মণিমালার মতে, ছাতা, ব্যাগ, শাড়ি, ওড়নার পটচিত্রে হয়তো ব্যবসা বাড়ছে, গাঁয়ের গরিব শিল্পীর রোজগার বাড়ছে, কিন্তু শিল্পটা এ ভাবে বাঁচবে না। ছাত্রছাত্রীদের তাই ধরে ধরে খাঁটি শিল্পটা শেখান তিনি। নিজেও ডুব দেন সাবেকিয়ানায়।

মাড় ছাড়া কাপড় মাপ করে কাটা হয়। তার পর একে একে বেল থেকে আঠা তৈরি, অপরাজিতা ফুল থেকে নীল রং, সিমপাতা থেকে সবুজ, পুঁইমেটুলি থেকে বেগুনি, মেহেন্দি থেকে লালচে খয়েরি, সেগুন পাতা থেকে খয়েরি, আতপ চাল বেটে সাদা ও লম্ফর শিখা থেকে কালো রং তৈরি করার পালা। প্রকৃতির রঙেই চিত্রিত হন সালঙ্কারা সিংহবাহিনী।

জীবন-কথার মণিমালা জানেন, তেপান্তরের রাজপুত্তুর নয়, পবনের নাও নয়, ‘সোনার দানা মোহর থান/ সাত রাজার ধন মানিক খান’ আছে মেয়েদের অন্তর্লীন শক্তিতে।

সেই শক্তির আঁচেই যে মণির অপার আভা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন