সে দিনের অভিযুক্তই আজ বিধায়ক

রং তো বটেই, বদলে গিয়েছে বাড়ির মালিকানা। তবু বছর ছয়েক আগের বৃষ্টিভেজা এক রাতের স্মৃতি বাড়ির সঙ্গে তার মালিককে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে। এখনও ওই বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় এলাকার বাসিন্দাদের চোখ অলক্ষ্যে আটকে যায় বাড়ির সামনের চত্বরটিতে। চাপা গলায় বলতে শোনা যায়— ‘ওই যে, বারান্দার পাশে ওইখানটায়।’

Advertisement

অর্ঘ্য ঘোষ

নানুর শেষ আপডেট: ১৪ মার্চ ২০১৬ ০২:৩০
Share:

• ২০১০ সালের ২৯ জুন খুন হন নানুরের প্রাক্তন বিধায়ক আনন্দ দাস।

Advertisement

• বাড়ির সামনেই আনন্দবাবুকে পিটিয়ে, বোমা মেরে খুন করা হয় বলে অভিযোগ।

• ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে পুলিশ ৪৮ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট জমা দেয়।

Advertisement

• চার্জশিটে রয়েছে বিদায়ী বিধায়ক গদাধর হাজরার নাম।

• শুরু হয়নি বিচার প্রক্রিয়া। পুলিশের ভূমিকায় ক্ষোভ রয়েছে সিপিএমে।

রং তো বটেই, বদলে গিয়েছে বাড়ির মালিকানা। তবু বছর ছয়েক আগের বৃষ্টিভেজা এক রাতের স্মৃতি বাড়ির সঙ্গে তার মালিককে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে। এখনও ওই বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় এলাকার বাসিন্দাদের চোখ অলক্ষ্যে আটকে যায় বাড়ির সামনের চত্বরটিতে। চাপা গলায় বলতে শোনা যায়— ‘ওই যে, বারান্দার পাশে ওইখানটায়।’

নানুরের সাকুলিপুরের দুধ-সাদা বাড়ির রং তখন হালকা গোলাপি। বাড়ির কর্তা এলাকার প্রাক্তন সিপিএম বিধায়ক আনন্দ দাস। বাড়ির সামনেই নৃশংস ভাবে খুন হন আনন্দবাবু (৫২)। পরে বাড়ি বিক্রি করে বোলপুরে চলে যান পরিজনেরা। পাল্টে যায় বাড়ির রং। ক্রমশ পাল্টাতে শুরু করে এলাকার পতাকার রংও। এ বারের বিধানসভা ভোটের আগে ফের চর্চায় উঠে আসছে সেই হত্যাকাণ্ডের কথা।

দিনটা ছিল ২০১০ সালের ২৯ জুন। ওই দিন বিকালে আরএসপি থেকে সদ্য তৃণমূলে যোগ দেওয়া সাওতা গ্রামের সামসুল হোদাকে নানুরের নতুনপাড়ার কাছে গুলি করে খুনের চেষ্টার অভিযোগ উঠে সিপিএম আশ্রিত দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে। কিছু পরেই নেমেছিল বৃষ্টি। প্রকৃতি ঠান্ডা হলেও রাজনৈতিক উত্তাপে ফুটতে থাকে এলাকা। তার বর্হিপ্রকাশ ঘটে সন্ধ্যায়।

সামসুলকে আক্রমণের পাল্টা হিসাবে আনন্দবাবুর বাড়ি থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে সিপিএমের জোনাল কমিটির অফিসে হামলা চালানোর অভিযোগ ওঠে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। ভাঙচুর, বোমাবাজি হয়। সেই সময় কার্যালয়ে থাকা সিপিএম নেতাকর্মীরা তিনতলায় উঠে পিছনের খড়ের গাদায় লাফ প্রাণে বাঁচেন।

সিপিএম কার্যালয়ে হামলার আঁচ পেয়ে দরজা-জানলা বন্ধ করে দিয়েছিলেন সাকুলিপুরের অধিকাংশ পরিবার। আলো পর্যন্ত নিভিয়ে দেন তারা। ব্যতিক্রম ছিল বিধায়কের বাড়ি। সে সময় বাড়িতে ছিল আনন্দবাবুর মেয়ে দশম শ্রেণির ছাত্রী চৈতি, দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র ঋজু এবং তাদের এক পিসতুতো দিদি। কর্মস্থল থেকে বাড়ি ফেরার পথে হামলার খবর পেয়ে গোপালনগরে দলীয় কর্মীদের সঙ্গে থেকে গিয়েছিলেন লাভপুর ব্লক অফিসের কর্মী, স্ত্রী হাসিদেবী। সে দিন দোতলা থেকে পার্টি অফিসে তাণ্ডবের দৃশ্য দেখে বাবার হাত ধরে পিছনের দরজা দিয়ে পালানোর কথা বলেছিল চৈতি। আনন্দবাবু কানে তোলেননি। চৈতির কথায়, ‘‘আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলেন কারও ক্ষতি করিনি। দেখিস আমার কিছু হবে না।’’

পরিবার সূত্রের খবর, সে বিশ্বাসে ভর করেই ঘেরা বারন্দায় এসে দাঁড়িয়েছিলেন আনন্দবাবু। গেটের দরজা খোলাই ছিল। পার্টি অফিসে তাণ্ডব শেষে আনন্দবাবুর বাড়ির পাশ দিয়ে ফিরছিল দুষ্কৃতীরা। রাজনীতির অলিন্দে থাকার সুবাদে অনেকের মুখ আনন্দবাবুর চেনা ছিল। বারন্দা থেকে তাদের উদ্দেশে আনন্দবাবু বলে ওঠেন, ‘‘কাজটা কি তোরা ভাল করলি?’’

কথাটা শেষ হয়নি। অভিযোগ, মুহূর্তে রে-রে করে তেড়ে আসে দুষ্কৃতীরা। টেনে হিঁচড়ে ফেলে বারান্দার সামনের চত্বরে আনা হয় আনন্দবাবুকে। শাবল দিয়ে বেধড়ক পিটিয়ে, বোমা মেরে খুন করা হয় বলে অভিযোগ পরিজনেরা। বাড়িতেও তাণ্ডব চালায় দুষ্কৃতীরা। ততক্ষণে পিছনের দরজা দিয়ে পড়শির বাড়িতে পালিয়ে গিয়েছিল আনন্দবাবুর ছেলেমেয়েরা।

এলাকা তখন থমথমে। নিস্তব্ধতা ভেঙে ডেকে চলেছে গুটি ক’য় রাস্তার কুকুর। রাত আটটা নাগাদ আনন্দবাবুর বাড়ির সামনে পৌঁছোয় পুলিশের জিপ। ততক্ষণে সবশেষ। পড়ে রয়েছে ক্ষতবিক্ষত দেহ। ইতিমধ্যে হয়ে গিয়েছে ঝির-ঝিরে বৃষ্টি। সেই বৃষ্টিতে ধুয়ে মাটিতে মিশছে রক্তের ধারা। আনন্দবাবুর ছেলেমেয়েরা তখনও জানত না বাবা আর নেই! জানতে পারে পরের দিন, ময়না-তদন্ত শেষে দেহ ফেরার পরে।

সে দিন বাবার মৃতদেহ আঁকড়ে চৈতি পুলিশের ভূমিকায় ক্ষোভ উগড়ে দিয়েছিল চৈতি। বলতে শোনা যায়, ‘‘পুলিশ সময়ে এসে বাবাকে এ ভাবে হারাতে হত না!’’

বাড়ি থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দূরে থানা থেকে পুলিশ আসতে কেন এত সময় লেগেছিল, সে নিয়ে চর্চা হয় আজও। এখন বোলপুরের সরকারি আবাসনে থাকেন হাসিদেবী। তিনি মন্তব্য করতে চাননি। কিন্তু ক্ষোভ গোপন করেননি সিপিএম নেতাকর্মীরা। ভোটের মরসুমে তাকে হাতিয়ারও করছেন নেতাকর্মীরা। চলছে প্রচার।

হত্যাকাণ্ডের পরে অভিযুক্ত হিসেবে উঠে আসে তৃণমূল নেতা গদাধর হাজরার নাম। দলের বর্তমান ব্লক সভাপতি সুব্রত ভট্টাচার্য-সহ ২১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের হয়। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে সুব্রতবাবুকে বাদ দিয়ে ৪৮ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট জমা দেয়। ওইটুকু।

সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য আনন্দ ভট্টাচার্যের অভিযোগ, ‘‘তৃণমূল নেতাদের আড়াল করতেই পুলিশ মামলা দীর্ঘায়িত করছে। অভিযুক্তদের গরহাজিরার কারণে পিছোচ্ছে মামলা।’’

বিচারাধীন বিষয় বলে মন্তব্য এড়িয়েছেন সে দিনের তৃণমূল নেতা বর্তমানে বিদায়ী বিধায়ক তথা নানুরের তৃণমূল প্রার্থী গদাধর। ঘনিষ্ঠ মহলে তাঁর বরাবরের অভিযোগ, ‘‘মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসানো হয়েছিল।’’

এই চাপান-উতরের মাঝেও সেই সন্ধ্যার কথা ভুলতে পারেনি নানুর। প্রয়াত বিধায়কের বাড়ির পাশ দিয়েই চলে গিয়েছে সাকুলিপুর ঢোকার ঢালাই রাস্তা। ওই রাস্তা দিয়েই যেতে হয় নানুর জোনাল কমিটির অফিসে। গ্রামবাসী তো বটেই, আগন্তুকদের নিয়ে রাস্তা দিয়ে যাওয়ার উঁচিয়ে বলতে শোনা যায়— ‘‘ওই যে, ওইখানে...’’ আলোচনায় ফিরে আসেন আনন্দ দাস। এলাকার চারবারের বিধায়ক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন