ঘড়িটা বন্ধ হয়েছিল ঠিক ৮টা ২৫শে

বিএসএফের বউ, তা ছাড়া ঘটনার ছিটেফোঁটাও তো দেখেননি? মহিলা মাথা নিচু করে বলছেন, ‘‘শুনুন, রাত বিরেতে এক তলায় সিঁড়ির মুখটা দেখেছেন, মনে হয় যেন রক্তে পিছলে যাব!’’

Advertisement

অনল আবেদিন

শেষ আপডেট: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০১:৪১
Share:

কে যেন দেখছে! পাহারায় ক্ষান্তমণির কুকুর। ছবি—গৌতম প্রামাণিক

বিএসএফের বউ, তা ছাড়া ঘটনার ছিটেফোঁটাও তো দেখেননি?

Advertisement

—মহিলা মাথা নিচু করে বলছেন, ‘‘শুনুন, রাত বিরেতে এক তলায় সিঁড়ির মুখটা দেখেছেন, মনে হয় যেন রক্তে পিছলে যাব!’’

পারত পক্ষে দুপুরেও একতলাটায় যাননা তিনি।

Advertisement

দেশের সীমানা আগলে পড়ে রয়েছে তাঁর স্বামী। ভরসা বলতে, ওই তো এক রত্তি মেয়ে। সে বাড়িতে মহিলা। অকপটেই বলছেন, ‘‘কিঞ্চিৎ সিঁটিয়েই থাকি বুঝলেন!’

তা, মহিলার ভয়কে তোয়াজ করলে তো! পড়শিরা দুপুরে বাড়ি এলেই ফেঁদে বসেন সেই গল্প— এই যে একতলার শোবার ঘব, আর ওই যে গো, তোমাদের রান্নাঘর ‘বডি’গুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছিল সব এখানেই। পান চিবোতে চিবোতে শুকনো রক্তের দাগ খোঁজেন তাঁরা।

দোষ কী দেওয়া যায় তাঁদের? রক্তের গল্প রসিয়ে বলতে কে নায় চান, একটু রহস্য একটু ভয় আর বাকিটা বেবাক অস্পষ্টতা। তবে, বহরমপুরের সোনাপট্টির স্বর্ণব্যবসায়ী কিঙ্কর দাস (৪৫), তাঁর স্ত্রী মিনতিদেবী (৩৭), তাঁদের ফুটফুটে দুটো ছেলে-মেয়ে— টুম্পা (১৬) আর সাগর (১৩), গলা কাটা অবস্থায় কেমন পড়েছিল? গল্পটা এখনও মুখে মুখে ফেরে। কেউ কেউ ধরিয়ে দেন,, ‘‘আর ওদের বন্ধু সুভাষ চন্দের দেহটা, ওটা তো পড়েছিল দোতলায়।’’

১৯৯৬’র ১০ নভেম্বর সন্ধ্যায় পরিবারের পাঁচ-পাঁচটা প্রাণ নিশ্চুপে খুন হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু অবাক কাণ্ড, রাত পৌনে ১২টার আগে কেউ টেরই পায়নি। সেই থেকে বাড়িটা তালাবন্দিই ছিল। বছর কয়েক আগে, মাত্র ছ’লাখ টাকায় সেটা কিনে এখন কি কি়ঞ্চিত আফসোসই হচ্ছে নবগ্রামের সেনা অফিসারের?

সোনাপট্টি এলাকার সরু গলি পরান শীল লেন। সেই গলির ভিতর পৈত্রিক দোতলা বাড়িতে থাকতেন কিঙ্করবাবু। স্বামী-স্ত্রী ও দুই সন্তান মিলে চার জনের সুখের সংসার। দুই ভাইয়ের মধ্যে কিঙ্করের ছোট শোভন থাকেন শহরের অন্য প্রান্তে, ইন্দ্রপ্রস্থ এলাকায়। কিঙ্করের ঘরের পাশেই তাঁর জেঠতুতো ভাই রাধামাধব দাসের ঘর। তিনি কাজ করেন শোভনের ইন্দ্রপ্রস্থের কাপড়ের দোকানে।

তা সে রাত ছিল ঘোর অমাবস্যার রাত। কালী পুজো। বাড়ির সামনে মন্দিরে মাইক, ঢাক-ঢোল, কাঁসর ঘণ্টা। উৎসব উপচে পড়ছে। বাড়িতে এসেছিল সাগরের বন্ধু সুভাষ।

দীপাবলির আলোকসজ্জার জন্য সাগরের বাড়ির দোতলায় টুনি লাগাচ্ছিল সুভাষ। বাড়ি থেকে ৫০-৬০ গজের মধ্যে কিঙ্করের সোনার দোকান। ঘটনার দিন সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ কিঙ্করকে ধূপধুনো দিতে দেখেছেন তাঁর কাকা নারায়ণ। পুলিশ বলছে— হঠাৎই একটা ফোন পেয়ে দোকানের কোলাপসিবল গেট টেনে তালা দিয়ে তড়িঘড়ি বাড়ি ফিরে গিয়েছিলেন তিনি। রাত পৌনে ১২টা নাগাদ বাড়ি ফিরে রাধামাধব তাঁর বৌদির কাছে চাবি চাইতে গিয়েই দেখেছিলেন সেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লাশগুলো। দরজা হাট করে খোলা, ঘর অন্ধকার আর, ‘‘রক্তের কী গন্ধ গো’’, অস্ফুটে বলছেন তিনি।

রাধামাধববাবু জানান, ডাকাডাকি করে কারও সাড়া না পেয়ে পাশের বাড়ি থেকে কাকা হিমাদ্রি দাসকে ডেকে এনেছিলেন তিনি। তার পরই পুলিশে খবর। ঘরে ঢুকতে গিয়ে পুলিশেরও পা পিছলে পড়ার জোগাড়।

সেই সময়ে বহরমপুর থানায় থাকা এক অফিসারের কথায়, ‘‘দেহগুলোর পাশ থেকে তিনটে রক্তমাখা ভোজালি পেয়েছিলাম।’’ তদন্তে নেমে পুলিশ জানিয়েছিল, সে কাজ অন্তত জনা সাতেকের। ভর সন্ধ্যায় পাঁচ-পাঁচটা খুন, আর কেউ টেরই পেল না?

প্রশ্ন ছিল আরও, কিঙ্করবাবুর হাতের ঘড়িটা ঠিক ৮.২৫-শেই বন্ধ হয়ে গেল কেন? পুলিশের দাবি, খুন পাঁচটা হয়েছিল ওই সাতটা থেকে সাড়ে আটটার মধ্যেই।

কালীপুজোর সন্ধ্যায় সারা সোনাপট্টি লোকে লোকারণ্য। গমগম করছিল পরান শীল লেনও। তার মধ্যে পাঁচ পাঁচটা বলি!

রাজ্য পুলিশের তৎকালীন ইন্সপেক্টার জেনারেল হায়দার আলি সফি এবং ডি আই জি (মুর্শিদাবাদ রেঞ্জ) দেবেন বিশ্বাস। তাঁরা জানিয়েছিলেন, ‘‘গোয়েন্দা আর এনফোর্সমেন্ট বিভাগ থেকে দু’টি দল গিয়েছিল তদন্তে, কিঙ্করবাবুর পকেট থেকে একটি ডায়েরি পেয়েছিল পুলিশ। তাতে যা হিসেব পেয়েছিল—দু’মাসে ১৮ লক্ষ টাকার কারবার। ব্যবসাটা তিনি যে খারাপ করতে না তারই প্রমাণ।’’

রাজ্য পুলিশের তৎকালীন ডিজি কমলকুমার মজুমদার বলেছিলেন, ‘‘কাছেই বাংলাদেশ সীমান্ত। পাচারের সংযোগও থাকতে পারে। সোনার লেনদেনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন কিনা তা-ও খতিয়ে দেখা হয়েছে।’’

সেই সব মন্তব্য আর বছরভর তদন্তঅন্তে গ্রেফতার হয়েছিল পদ্মাপাড়ের জলঙ্গি থেকে আশরাফুল ইসলাম নামে এক স্বর্ণব্যবসায়ী আর কিঙ্করের ভাই শোভন দাস। গ্রেফতার করা হয়েছিল আরও তিন স্বর্ণব্যবসায়ী। পুলিশের এক বড় কর্তা বলেছিলেন, ‘‘কেস’টা সোজা, কিঙ্করবাবু সম্ভবত সোনা চোরাচালানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।’’

তবে প্রথামিক গ্রেফতার হলেও পরে বেকসুর খালাস পেয়েছিলেন শোভন। তাহলে?

কে, কেন, কী করে— নাঃ, সে সব উত্তর আজও মেলেনি। পরাণ শীল লেন গভীর রাতে সেই তার উত্তর খোঁজে এখনও, নিশ্চুপে।

আর বাড়ির এক তলাটা এড়িয়েই চলেন মহিলা। বলেন, ‘‘কেমন যেন ছমছম করে, মনে হয় কে যেন আমায় দেখছে জানেন!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন