১৯৮৭-তে দিল্লিতে রাষ্ট্রপতি ভবনের কাজ ছেড়ে দিয়ে এলাম শান্তিনিকেতনে সপরিবার। যোগ দিয়েছি কলাভবনে। শর্বরীদা (শর্বরী রায়চৌধুরী) শ্রীনিকেতনের কাছাকাছি ‘ফরটি ফাইভে’ রবীন্দ্র-বিশেষজ্ঞ সত্যেন্দ্রনাথ রায়ের ছাদের ওপর দু’রুমের বর্ষাতি ঠিক করে দিলেন আটশো টাকা মাসিক।
দক্ষিণের হাওয়ায় ঘরের সব কিছু উড়ে যাবার মতো আর কী! জানালা দিয়ে দেখা যায় খোলা মাঠ— দু’দিকে ধু ধু করছে— বর্ষার দিনে রাতের আলোর লোভে অজস্র পোকামাকড়ে ঘর ভর্তি হয়ে যায়। বন্ধুরা অবাক হয়ে বলল, এত ভাড়া দিচ্ছেন! আট মাস পরে চলে এলাম রতনপল্লি। কালোর দোকান মাত্র দু’মিনিটের দূরত্ব।
‘ফরটি ফাইভে’ একটি মাত্র দোকান ছিল। এখানে দোকান বাজার-পোস্টঅফিস, চায়ের দোকান, মিষ্টির দোকান, রং-তুলি, কাগজের দোকান, মেডিসিন শপ, জেরক্স, সব কিছু হাতের নাগালের মধ্যে। আর কলাভবন ঠিক আট মিনিট পায়ে হেঁটে। রতনকুঠিকে ডান দিকে রেখে পুরনো মেলার মাঠের মধ্যে দিয়ে, ছাতিমতলা আর উত্তরায়ণের মাঝখান দিয়ে সব কিছু দেখতে দেখতে ‘নন্দন’-এর পাশ দিয়ে রোজ হেঁটে কলাভবনে যাই।
উত্তরায়ণের সামনে অনেকগুলি কুর্চি ফুলের গাছ। বসন্তের সময়ে অজস্র সাদা ফুল ভরে থাকে। কলাভবন চত্বরে যেতেই ডান দিকে চোখে পড়ত রামকিঙ্করের সৃষ্ট ভাস্কর্য ‘সাঁওতাল পরিবার’— এবড়ো-খেবড়ো সিমেন্ট আর পাথরকুচি দিয়ে তৈরি— কী বলিষ্ঠ মাধুর্যময় সেই মূর্তি। যেতে যেতে মনে হত, এই সব জায়গায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পায়ে হেঁটে বেড়িয়েছেন। সেখান দিয়ে হাঁটছি। তাঁর উপস্থিতি অনুভব করতাম।
এস এন চ্যাটার্জিদের যে বাড়িটিতে আমরা থাকতাম, তার বাগানে একটি আমগাছ ছিল— বসন্তে মুকুলে ভরে যেত। আম ফলত প্রচুর। বাড়ির সামনে মোরামের রাস্তা বড় জোর ১০/১২ ফুট চওড়া। উল্টো দিকে ছিল দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের ছোট্ট একটি বাড়ি, নাম ‘লোকায়ত’। এর পাশ দিয়ে একটি রাস্তা সোজা পৌঁছেছে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়ির পিছন দিকটায়, বাড়িটির নাম যত দূর মনে পড়ে ‘অবসর’। ওখানেই আচার্যদের বাড়ি। ওদের দুই মেয়ে। বড়টি বেশ সুন্দরী। ছোট মেয়ে ‘জুন’ শিক্ষাদীক্ষা-খেলাধুলো-গান-ছবি আঁকা— সবেতেই পটু। জুন হল শিঞ্জিনী আচার্য, এখন রবীন্দ্রসঙ্গীতে বেশ পরিচিতি লাভ করেছে। কিছু দিন আমার কাছে ছবি আঁকার পাঠ নিয়েছিল। ওর আঁকা ছবি দেখাতে নিয়ে আসত।
ওদের বাড়ির উল্টো দিকে বেশ বড় বাগানওয়ালা একটি বাড়ি— বছরখানেকের মধ্যেই আমরা বাড়িটি ভাড়া নিয়ে চলে গেলাম। বড় বড় ঘর। পরিচিতির সূত্রে অনেকেই আমাদের এই দুই ভাড়া বাড়িতে পা রেখেছেন। সেলিমা হাসমি, জাহি শাহ, নিভেল-তুলি, পূর্ণেন্দু পত্রী— অনেকে।
১৯৯৩-এ রতনপল্লিতেই ১০ কাঠা জমির উপরে একটি পুরনো বাড়ি কিনে, তাতে আরও কয়েকটি ঘর সংযোজন করি, দোতলায় বড় স্টুডিও তৈরি করে সেখানে চলে আসি। ডিজাইনটা প্রায় আমারই করা। সব মিলিয়ে চার হাজার স্কোয়ার ফিটের স্পেস। পিছনের দিকে সবুজ ঘাসের ‘লন’। বাড়ির পশ্চিমে মুনিয়াদের (আলপনা রায়) বাড়ি। কাছেই বুদ্ধদেব গুহ-ঋতু গুহ, পুবে কলকাতার সরকারদের এবং উত্তরে লীলা মজুমদারের বাড়ি, প্রায় দু’ বিঘা জমির উপরে। দক্ষিণে থাকেন মাসিমা অর্থাৎ মুকুলরানী সেন। রাস্তার ও পাশে ক্ষিতীশ রায়, শর্মিলা, মিষ্টুনিদের বাড়ি— তার পরেই অমিয় চক্রবর্তীর বাড়ি ‘রাকা’ এবং রতনকুঠি।
বাড়িটিতে যখন আমরা ছিলাম, আমি কলাভবনের শিক্ষকতার কাজে, নিজের ছবি আঁকা ও নানা সাংস্কৃতিক সাংগঠনিক কাজে ব্যস্ত থাকতাম। ছাত্রছাত্রী, বন্ধুবান্ধব, বিভিন্ন গ্যালারির মানুষজনের আনাগোনায় সর্বদা বাড়িটি প্রাণপূর্ণ হয়ে থাকত। দোতলায় আমার স্টুডিও। সামনে খোলা ছাদ। এই বাড়িটা আমার খুব প্রিয়। এখানেই আমরা বসন্ত উৎসবের আগের সন্ধ্যায় গান-কবিতার আসর শুরু করি।
প্রথম দিকে আমরা ছাদের উপরে অনুষ্ঠানটি করতাম। পরে মোহন সিংহ যখন আসতে শুরু করলেন, নীচে লনের উপরে অনুষ্ঠান নামিয়ে আনলাম। শক্তি (চট্টোপাধ্যায়) যে বার মারা গেলেন, সে বার ছাদের উপরে জমাট আসর বসেছিল। শক্তির উদাত্ত গলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত, তার পরেই সুনীলবাবুর (গঙ্গোপাধ্যায়) গান। সে দিন মিষ্টুনি, সঙ্গে ওর স্বামী আন্টনি বেভিন্স— ওঁরা আবৃত্তি করলেন। আবৃত্তি করেছিলেন সৌমিত্র মিত্র, নমিতা— আমার বোন, আরও অনেকে। আরও যাঁরা আসতেন তাঁরা হলেন চিদানন্দবাবু, তাঁর স্ত্রী সুপ্রিয়া, মেয়ে অপর্ণা, বিক্রম সিংহ, রাজা (সন্দীপ সেন), আমার ভাইবোনেরা ও শান্তিনিকেতনের বন্ধুরা।
লীলা মজুমদারের মেয়ে কমলি আমাদের বেড়ার ও পারে দাঁড়িয়ে এক দিন বললেন, ওঁদের বাড়িটা বিক্রি করার কথা ভাবছেন। আমি বললাম, ‘করলে আমায় বলবেন।’ অবশেষে গত ৮/৯ বছর হল আমরা ‘লীলা মজুমদারের বাড়ি’তে। অনেক গাছপালা নিয়ে বসবাস। যথারীতি বহু কবিতা ও গানের অনুষ্ঠান এখানেও হয়েছে। বুদ্ধদেব গুহ এক দিন সকালে আমাদের বারান্দায় এসে গান গাইলেন। পাশে সরকারদের পুরনো বাড়ি এবং একটা নতুন বাড়ি। শীতের সময়ে যখন বাড়ির লোকজন আসেন, দেখি রাতে আলো জ্বালিয়ে ব্যাডমিন্টন খেলছেন। এক বার ওঁদের সঙ্গে খুব আড্ডা হয়েছিল। অমিতাভ চৌধুরীও (শ্রীনিরপেক্ষ) ছিলেন— তিনি তখন ‘দেশ’ পত্রিকার সম্পাদক।
কলকাতা শহরের মতো এখানে ঠিক পাড়া বলে কিছু নেই। ঘরবাড়ির প্রায় অধিকাংশই সারা বছর খালি পড়ে থাকে। কেয়ারটেকাররা থাকেন। কোনও সঙ্ঘবদ্ধ পাড়া বলে কিছু নেই। তাই পড়শিও তেমনই। তবে বেশ ভাল লাগে এই নির্জনতা। আমাদের বাড়ির চারদিকে পথে-পথে প্রচুর গাছপালা, ঝোপঝাড়। আমাদের বাড়ির পরিবেশও তাই।
আমরা নিজেদের জমি থেকে জল তুলি। বর্ষায়, ঝড়ে, গ্রীষ্মে, বসন্তে— দারুণ লাগে এখানে। কলকাতা থেকে ফিরে এখানকার খোলামেলা হাওয়ায় থাকতে খুব ভাল লাগে। আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তা এখনও মাটির, সামান্য মোরাম ফেলা— দু’পাশে এলোমেলো ঘাস— কেউ ময়লা পরিষ্কার করতে আসে না। তা সত্ত্বেও বেশ ভাল লাগে এখানে।