পুজো আসার অনেক আগে পুজো শুরু হত

যে দিন সাতক্ষীরা থেকে শশী পটুয়া বাড়িতে ঠাকুর গড়তে আসতেন, সে দিনই ঢাক বাজত। পুজো যেখানে হত, তার সামনের মাঠে একাদশী থেকে লক্ষ্মীপুজো অবধি রোজ থিয়েটার। পুজোর সময় খুব নাটক হত আমাদের। একাদশী থেকে লক্ষ্মীপুজো পর্যন্ত। শখের থিয়েটার। বড়রা একটা নাটক করত, মেজোরা একটা নাটক করত। সে নাটক পারিবারিক নয়, গ্রামের নাটক। পুজো যেখানে হত, তার সামনে একটা মাঠে নাটক হত।

Advertisement

মনোজ মিত্র

শেষ আপডেট: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০১:২২
Share:

মনোজ মিত্র

তখন গোটা গ্রামে একটা কিংবা দু’টো পুজো হত। আমাদের দিনগুলো, রাতগুলো কাটত ওই দু-একটা পুজোকে কেন্দ্র করেই।

Advertisement

আমার ছেলেবেলা গ্রামেগঞ্জে কেটেছে। আমাদের দেশ ছিল খুলনা জেলায়। সেখানে আমি ১৯৫০ সাল অবধি ছিলাম। প্রায় ১২ বছর বয়স অবধি। পূর্ববঙ্গের নানা প্রান্তে ঘুরেছি বাবার চাকরিসূত্রে। টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, আরও কত জায়গা! সে সব জায়গা এত সুন্দর, অমন গ্রাম হয়তো আর দেখা যাবে না কোনও দিন।

আমাদের বাড়িতেই ঠাকুর গড়া হত। যে দিন পটুয়া ঠাকুর গড়তে আসবে, সে দিন থেকেই শুরু হয়ে যেত পুজো। সে একটা ঘটনা ছিল। সে দিনই ঢাক বাজত, ঢোল বাজত। লোকজন সকলে হাজির। কেউ কলাগাছের কলা কেটে আনছে, কেউ নারকোলগাছ থেকে নারকোল, পুজোয় লাগবে বলে। সে দিন থেকে শুরু হত প্রস্তুতি।

Advertisement

এ দেশে নারকোলগাছ ছিল খুব। তার থেকে নানা রকম মিষ্টি-মেঠাই হত। পুজো আসার অনেক আগেই পুজো শুরু হয়ে যেত আমাদের। মানে ঢাক-ঢোল বাজিয়ে শুরু হত। ঢাক-ঢোলটা ছিলই। যে দিন প্রথম শশী পটুয়া সাতক্ষীরা থেকে ঠাকুর গড়তে আসতেন, সে দিন থেকেই বাজনা শুরু হত। সাতক্ষীরার গায়ে ছিল আমাদের বাড়ি।

পুজোর সময় খুব নাটক হত আমাদের। একাদশী থেকে লক্ষ্মীপুজো পর্যন্ত। শখের থিয়েটার। বড়রা একটা নাটক করত, মেজোরা একটা নাটক করত। সে নাটক পারিবারিক নয়, গ্রামের নাটক। পুজো যেখানে হত, তার সামনে একটা মাঠে নাটক হত। সে ছিল বাড়ির লাগোয়াই। সে সব পোশাক, সরঞ্জাম নিয়ে যাওয়া হত। তখন আমি অভিনয় করিনি। কিন্তু নাটকের কথা খুব মনে আছে। অভিনয় করিনি, কেন না, তখন আমাদের ছোটদের নাটক দেখতে দেওয়াই হত না। যেটুকু দেখেছি লুকিয়েচুরিয়ে। দেখার খুব উৎসাহ থাকত। ছটফট করতাম। আমার ঠাকুরদা ছিলেন ঘোর নাটকবিরোধী। তিনি রোগগ্রস্ত ছিলেন অনেক বছর ধরে। তিনিই বাড়ির কর্তা। কখনও চাইতেন না, বাড়ির ছেলেরা রাত জেগে নাটক করবে, বা দেখবে।

এক বারের কথা মনে পড়ছে। নাটকের কথা, খুব অদ্ভুত। সে বার শরৎচন্দ্রের একটা নাটক হচ্ছে। রামের সুমতি। প্রতিবেশী একটি ছেলে অভিনয় করছে। পড়শি বলতে তখন সব দাদা-কাকাদের মধ্যেই। একান্নবর্তী পরিবারে তখন কাছের সম্পর্ক সকলের মধ্যে। হয়তো ও-বাড়ির দাদা অভিনয় করছে। সে যখন চান্স পেয়েছে, আমাদেরও মনে হল, নাটক দেখার অনুমতি দেওয়া হোক। বললাম, ও অভিনয় করলে, আমরা কেন দেখতে পারব না! দেখতে গিয়ে একটা ঘটনা ঘটল। নাটক তো কিছুতেই জমছে না। মেয়েদের ভূমিকায় ছেলেরাই অভিনয় করছে। সারা ক্ষণ তারা কাপড় টানতে ব্যস্ত। তারই মাঝে, কানে কম শোনেন এক অভিনেতা, তিনি উইংসের পাশে গিয়ে প্রম্পটারকে বললেন, ‘‘জোরে বল!’’ সবাই হাসছে। মঞ্চে মাছ নিয়ে প্রবেশের দৃশ্যে হঠাৎ হল কী, দু’টো জ্যান্ত মাছ ঝুড়ি থেকে স্টেজে লাফিয়ে পড়ল! সারা স্টেজ তারা লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। সেই দেখতে দর্শকও হামলে পড়ল। সকলে যেন চনমনে হয়ে উঠল। মানে, এত ক্ষণে দু’টো জ্যান্ত জীব মঞ্চে উঠল!

এর পরের বছর শীতকালে আমরা চলে আসি। সে বার পুজোয় ছোটদের দিয়ে নাটক করানো হল। মাঠে নয়, সে বার ঠাকুরদালানে অভিনয় হল। বিজয়া সম্মিলনীতে। রবীন্দ্রনাথের ‘রোগের চিকিৎসা’ নাটকে আমি অভিনয় করলাম হারাধন চরিত্রে। সেই প্রথম। গল্প তো সবার জানা। ঠিক ছিল, ছোট কাকিমা তুলোর হাঁস করে দেবেন। নাটকের দৃশ্যে পেটে খোঁচা মারলে উইংসের পাশে ডিরেক্টর হাঁসের আওয়াজ করবেন।

আমার মনে পড়ল মাছের কথা। ইচ্ছে হল, মাছ দু’টো জ্যান্ত দেখেছিলুম, হাঁসও যদি জ্যান্ত রাখা হয়! লোকের উৎসাহ বেড়ে যাবে। বিকেল থেকে একটা জ্যান্ত হাঁস পেটের মধ্যে ভরে রেখেছিলাম। কিন্তু কেউ জানত না। ডিরেক্টরকেও বলিনি। হল কী, সেই দৃশ্যে পেটে খোঁচা পড়তেই জ্যান্ত হাঁস ডেকে উঠল! ডিরেক্টরও ডেকেছেন। লোকজন হইচই শুরু করল। ‘‘আরে, সত্যি জ্যান্ত হাঁস পেট থেকে বেরল!’’ সে দিন থিয়েটার জমে গেল। আমার কারণে নয়, হাঁসের কারণে।

জামা খুলে যখন হাঁস বের হল, গোটা পেটে হাঁসের নখের দাগ, রক্তাক্ত। যখন বের হল, দর্শকরা খুব মজা পেয়েছে। দর্শক তো চায় মঞ্চের উপরে বাস্তবটা দেখব। সত্যটা দেখব। লোকে বলেছিল নাটকটা আমার জন্য খুলেছিল, তা নয়। হাঁসটার জন্যই।

সেই পুজোয় প্রথম নাটক। এর পরে বহু নাটক, কত স্মৃতি!

পুজোতে নাটকও লিখেছি। ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রথম পুজোর নাটক লিখলাম, সেটা ১৯৮১ বোধহয়। নাটকের নাম ‘রাজদর্শন’। সাগরময়দা বলেছিলেন লিখতে। ‘দেশ’-এ নাটক লিখতে হবে, এই খবরটা দিয়েছিল সমরেশ মজুমদার। এক দিন বেলগাছিয়ায় আমাদের বাসায় এসে বলল, ‘‘সাগরদা ডেকেছেন, লিখতে হবে।’’ লিখলাম। পরেও বলেছেন, উপন্যাস লিখতে। ‘রাজদর্শন’-এর আগে বাদলবাবুর দু’টো নাটক বেরিয়েছিল সত্তরের দশকের শেষের দিকে। তার পরেই উনি আমাকে লিখতে বললেন। তার আগে ‘চাকভাঙা মধু’, ‘পরবাস’, ‘অশ্বত্থামা’ ‘সাজানো বাগান’ নাটক প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত হয়েছে ‘দর্পণে শরৎশশী’। সৌমিত্রদা’রা অভিনয় করেছিলেন। তার পর ‘নাকছাবিটা’, ‘পালিয়ে বেড়ায়’, ‘ছায়ার প্রাসাদ’, ‘মুন্নি ও সাত চৌকিদার’— কত নাটক। পুজোর নাটক লেখা নিশ্চয়ই একটা অন্য রকম অনুভূতি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন