রীতিমতো ‘আমরা-ওরা’র খেলায় নেমেছে শীত। এবং সেই সঙ্গে বসন্তও।
এই ‘আমরা-ওরা’র খেল্ চলছে কলকাতা আর মফস্সলের মধ্যে। মহানগরীতে সকালে হি-হি করা উত্তুরে হাওয়া নেই। বেলা গড়াতেই বাতাসে গরম ভাব। সন্ধে গড়ানোর পরে একটু যা হিম-হিম ছোঁয়া। তাতেই কিছুমিছু শীত উদ্যাপন।
অথচ ক্যালেন্ডারে মাঘ মাস। তিথি শ্রীপঞ্চমী। কিন্তু বুধবার, সরস্বতী পুজোর দিন থেকেই কলকাতার আবহাওয়ায় পুরোদস্তুর বসন্তের আগমনি! কয়েক দিন ধরেই শীতের বিদায়-ঘণ্টা সমানে বাজিয়ে যাচ্ছিল হাওয়া অফিস। আবহবিদদের অনুমান ছিল, মাঘের বাঘা শীত পাওয়ার আশা এ বারের মতো শেষ। বরং মাঘ পেরোনোর আগেই হাজির হবে বসন্ত। সারা মরসুম দুর্বলতায় ভুগতে থাকা শীত মাথা তুলে দাঁড়ানোর সামর্থ্য অর্জন করে উঠতে পারবে না। সেই অনুমানকে সত্যি করে শ্রীপঞ্চমীতে অর্থাৎ বাঙালির আদি প্রেমদিবসেই কার্যত বসন্তের সূচনা করে দিয়েছে প্রকৃতি। শীতকে প্রায় ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বাতাসে বাতাসে নির্ঘোষ, বসন্ত এসে গেছে! বসন্ত-সমাগমের চঞ্চলতায় অবশ্য শীতের অকাল-বিদায়ের ব্যথাও মিশে যাচ্ছে।
মফস্সলে কিন্তু বসন্তকে সহজে ময়দান ছেড়ে দিচ্ছে না হিম-হাওয়া। উত্তরবঙ্গ হোক বা দক্ষিণ, বিভিন্ন জেলায় শীতের উপস্থিতি ভালই মালুম হচ্ছে। বীরভূমের শ্রীনিকেতনে এ দিন সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১১.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস, স্বাভাবিকের থেকে তিন ডিগ্রি কম। বাঁকুড়া আর আসানসোলে রাতের তাপমাত্রা ১৩ ডিগ্রির কাছেপিঠে রয়েছে। উত্তরবঙ্গে তরাই-ডুয়ার্সের বিভিন্ন জেলাতেও রাতের তাপমাত্রা ১২-১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। আবহবিদেরা জানিয়ে দিচ্ছেন, কলকাতায় যা-ই হোক, জেলাগুলিতে বসন্ত আসছে না এখনই। বরং চলতি সপ্তাহেও সেখানে কমবেশি শীতের দাক্ষিণ্য পাওয়া যাবে।
একই রাজ্যে প্রকৃতির এমন আমরা-ওরা বিভাজন কেন?
আলিপুর আবহাওয়া দফতরের এক শীর্ষ কর্তা জানান, জেলাগুলিতে তাপমাত্রা সাধারণ ভাবে কলকাতার তুলনায় কম থাকে। তাই সেখানে পারদের ঊর্ধ্বমুখী যাত্রা শুরু হয়ে গেলেও পাততাড়ি গোটাতে শীত কয়েকটা দিন বেশি সময় নেবে। ‘‘জেলাগুলির অনেক জায়গাতেই রাতের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের উপরে উঠে গিয়েছে। কিন্তু মানুষের শীত-বোধ তো আর থার্মোমিটার দিয়ে হয় না। কলকাতায় শীতের জন্য যতই হাপিত্যেশ চলুক, এ ক্ষেত্রে প্রকৃতির কিঞ্চিৎ পক্ষপাত থেকে যাবে জেলার দিকে,’’ মন্তব্য ওই আবহবিজ্ঞানীর।
এমন নয় যে, মফস্সল বসন্ত-বিরোধী। কলকাতাও নয় শীত-বিদ্বেষী। বরং শীত-প্রেমে কারও চেয়ে কম যায় না মহানগরী। তা হলে শীত এত দ্রুত শহর ছাড়ল কেন?
আবহবিদেরা জানান, ঘূর্ণিঝড়ের পর ঘূর্ণিঝড় ও ঘূর্ণাবর্তে এ বার সূচনা থেকেই হোঁচট খেতে হয়েছে শীতকে। মকর-সংক্রান্তি আর মাঘ-পয়লা মিলিয়ে দিন তিনেক দাপটে ব্যাট চালালেও ক্রিজে থিতু হতে পারেনি সে। বিদায় পর্বটাও তড়িঘড়ি শেষ হল সেই নড়বড়ে স্টান্সের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। আবহাওয়া দফতর জানাচ্ছে, বুধবার কলকাতার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১৬.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস, স্বাভাবিকের থেকে এক ডিগ্রি বেশি। আবহবিদদের পূর্বাভাস, এ বার থেকে মহানগরে রাতের তাপমাত্রা বাড়তেই থাকবে। এবং উত্তুরে হাওয়া মিলবে না বললেই চলে। আগামী সপ্তাহের গোড়ায় কলকাতার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা পৌঁছে যেতে পারে ১৮ ডিগ্রিতে।
বসন্ত সাততাড়াতাড়ি খাতা খুললেও বাঙালির ভ্যালেন্টাইন দিবসে শীত-বিদায়ে আক্ষেপ ঝরে পড়েছে অনেকের গলায়। সরস্বতী পুজোর অঞ্জলি দিয়ে উঠেই এক তরুণীর আক্ষেপ, ‘‘ইস, শীতটা আরও ক’দিন থেকে গেলে পারত!’’
কোনও কোনও প্রবীণ আবার ডুব দিয়েছেন ছোটবেলার স্মৃতিতে। বলছেন, ‘‘ছোটবেলায় সরস্বতী পুজোর সকালে স্নান করার পরে কাঁপুনি ছাড়তে চাইত না। আর এখন? শীত যে কবে এল আর কবে চলে গেল, সেটাই বুঝতে পারছি না!’’