কুকুর কাণ্ডে বদলি অধিকর্তা, আর্জি জানালেন স্বেচ্ছাবসরের

টানা সাত বছর তিনি ছিলেন এসএসকেএমের অধিকর্তা। হঠাৎই কম গুরুত্বের সাগর দত্ত মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে সরিয়ে দেওয়া হল হল সেই প্রদীপ মিত্রকে। স্বাস্থ্যভবন এই বদলিকে রুটিন বললেও স্বাস্থ্য ভবনের কর্তারা জানাচ্ছেন— কুকুর-কাণ্ডের জেরেই প্রদীপবাবুকে সরিয়ে দিয়েছে সরকার। ‘অপমানিত’ প্রদীপবাবু এ দিন বদলির চিঠি হাতে পেয়েই স্বেচ্ছাবসরের জন্য আবেদন করেছেন বলে দফতরসূত্রে খবর।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৪ জুন ২০১৫ ০৩:৪৩
Share:

টানা সাত বছর তিনি ছিলেন এসএসকেএমের অধিকর্তা। হঠাৎই কম গুরুত্বের সাগর দত্ত মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে সরিয়ে দেওয়া হল হল সেই প্রদীপ মিত্রকে। স্বাস্থ্যভবন এই বদলিকে রুটিন বললেও স্বাস্থ্য ভবনের কর্তারা জানাচ্ছেন— কুকুর-কাণ্ডের জেরেই প্রদীপবাবুকে সরিয়ে দিয়েছে সরকার। ‘অপমানিত’ প্রদীপবাবু এ দিন বদলির চিঠি হাতে পেয়েই স্বেচ্ছাবসরের জন্য আবেদন করেছেন বলে দফতরসূত্রে খবর।

Advertisement

তৃণমূলের চিকিৎসক নেতা নির্মল মাজির ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ার কুকুরের ডায়ালিসিসের জন্য এসএসকেএম-এর নেফ্রোলজি বিভাগে সব ব্যবস্থা পাকা করে ফেলেছিলেন বিভাগীয় প্রধান রাজেন পাণ্ডে। তাঁর এই উদ্যোগে অনুমোদন দিয়েছিলেন প্রদীপবাবুও। তৃণমূলের চিকিৎসক নেতাদের একাংশ বলছেন, ‘‘কুকুর-কাণ্ডে রাজ্য সরকারের যে ভাবে মুখ পুড়েছে, তাতে প্রদীপবাবুকেই বলির পাঁঠা করল স্বাস্থ্য ভবন।’’ প্রদীপবাবু অবশ্য বলেন, ‘‘এই সিদ্ধান্তে আমি অপমানিত বোধ করেছি। মনে করছি আমার পদাবনতি করা হয়েছে। নতুন দায়িত্বে আমি যোগ দেব না। স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিকর্তাকে তা জানিয়েও দিয়েছি।’’ কুকুর কাণ্ডের সব দায় অস্বীকার করে প্রদীপবাবু দাবি করেন, বিষয়টি জানতে পেরে তিনিই ডায়ালিসিস বন্ধ করার ব্যবস্থা করেন। তিনি বলেন, বিষয়টি তাঁর অজান্তেই হচ্ছিল।

শুধু প্রদীপবাবুর বদলিই নয়, তাঁর জায়গায় যাঁকে এসএসকেএম-এর অধিকর্তার দায়িত্ব দেওয়া হল— নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ সেই মঞ্জু বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়েও তৃণমূলের চিকিৎসক নেতাদের মধ্যে প্রশ্ন রয়েছে। তাঁদের অভিযোগ, ‘‘নীলরতনের হস্টেলে কোরপান শাহকে পিটিয়ে মারার ঘটনায় জুনিয়র ডাক্তারদের নানা ভাবে তিনি আড়াল করেছেন। এ ক্ষেত্রেও নির্মল মাজির নির্দেশই পালন করেছিলেন মঞ্জুদেবী।’’ চিকিৎসক নেতাদের মতে, এই ভাবে তাঁকে পুরস্কার দেওয়াতেও কম মুখ পুড়ল না রাজ্য সরকারের!

Advertisement

এ দিনই নীলরতনের দায়িত্ব ছেড়ে এসএসকেএম-এ যোগ দিয়েছেন মঞ্জুদেবী। এত তড়িঘড়ি কেন মঞ্জুদেবীকে নতুন পদে যোগ দেওয়ানো হল, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠে গিয়েছে। চিকিৎসক সংগঠন ‘অ্যাসোসিয়েশন অব হেল্থ সার্ভিস ডক্টর্স’-এর সভাপতি সত্যজিৎ চক্রবর্তী বলেন, ‘‘নির্মল মাজি আর রাজেন পাণ্ডেকে আড়াল করতেই প্রদীপ মিত্রকে সরানো হল। যে দ্রুততায় নতুন অধিকর্তা এ দিনই কাজে যোগ দিলেন, তাতে কিন্তু অনেক প্রশ্ন উঠে আসছে।’’

প্রদীপ মিত্র শস্তি পেলেও কেন কুকুর-কাণ্ডের মূল দুই নায়ক নির্মল মাজি এবং রাজেন পাণ্ডের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হল না?

রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘প্রদীপ মিত্রের বদলির সঙ্গে কুকুর-কাণ্ডের কোনও যোগ রয়েছে বলে আমি স্বীকার করছি না। আর নির্মল মাজি আর রাজেন্দ্রনাথ পাণ্ডেকে নিয়ে কী করব? সংবাদপত্রের খবরের ভিত্তিতে তো কাউকে ফাঁসি দেওয়া যায় না! আগে নিজেরা বিষয়টা খতিয়ে দেখি, তার পর যা করার করব।’’

তা হলে কি কুকুর-কাণ্ড নিয়ে কোনও তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য দফতর? তার আগেই কী ভাবে বদলি করে দেওয়া হল প্রদীপবাবুকে? এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য ভবন কোনও মন্তব্য করতে চায়নি। তবে তৃণমূলের চিকিৎসক নেতাদের একাংশের বক্তব্য, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর অতি ঘনিষ্ঠ বলেই এসএসকেএম হাসপাতালের নেফ্রোলজির প্রধান রাজেন পাণ্ডেকে রেহাই দেওয়া হল। শুধু তাই নয়, রাজেন পাণ্ডে এসএসকেএম হাসপাতালের নেফ্রোলজি বিভাগের সঙ্গে সঙ্গে শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালের নেফ্রোলজি বিভাগের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। পাণ্ডের অতিরিক্ত দায়িত্বও ছাঁটা হয়নি। চিকিৎকদের মধ্যে এর ফলে ভুল বার্তা যাবে।’’

এক চিকিৎসক নেতার মন্তব্য, ‘‘নির্মল মাজিকে ডেকে পাঠিয়ে মুখ্যমন্ত্রী তিরস্কার করেছেন। এ ভাবেই হয়তো তিনি সতর্ক করে দিয়েছেন পাণ্ডেকে। তবে তাঁর দায়িত্ব কমেনি। আর নির্মলও স্বাস্থ্য দফতরের বিভিন্ন কমিটিতে এবং রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলের সভাপতি পদে দিব্যি রয়ে গিয়েছেন!’’

এ সব নিয়ে রাজেন পাণ্ডের সংক্ষিপ্ত মন্তব্য, ‘‘এটা প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত। আমার কিছু বলার নেই।’’

আর নির্মল মাজি কী বলছেন? তিনি বলেন, ‘‘এসএসকেএম-এর সুপার, ডেপুটি সুপার সবাইকেই নতুন আনা হয়েছে। এ বার ডিরেক্টরকেও বদলি করা হল। উনি বহু দিন ধরে আছেন। এক পদে কেউ বেশি দিন থাকলে ঘুঘুর বাসা হয়ে যায়। ধাপে ধাপে পুরনো সকলকেই বদলি করা হবে। তা ছাড়া সাগর দত্ত নতুন কলেজ। সেখানে প্রদীপবাবুর মতো অভিজ্ঞ প্রশাসক প্রয়োজন।’’ প্রদীপবাবু এবং রাজেনবাবু দু’জনেই কুকুর-কাণ্ডের বিষয়টি গোড়ায় স্বীকার করে নিলেও ঘটনার ১০ দিন পরে এখন নির্মল মাজি বলছেন, ‘‘এ রকম ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বলার মতো কিছুই ঘটেনি। আমাকে অযথা কালিমালিপ্ত করা হচ্ছে!’’

স্বাস্থ্য ভবন সূত্রের খবর, গত ১০ জুন নেফ্রোলজির প্রধান রাজেনবাবু এসএমএস করে হাসপাতালের অধিকর্তা প্রদীপবাবুর কাছে নির্মল মাজির ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ার কুকুরের ডায়ালিসিস করার অনুমতি চান। রাজেনবাবুর কাছে অনুরোধটি এসেছিল নির্মল মাজির কাছ থেকেই। প্রদীপবাবু প্রাথমিক কিছু প্রশ্ন তুললেও পরে অনুমতি দিয়ে দেন। শেষ পর্যন্ত সেই সময়ে নেফ্রোলজির যে চিকিৎসক ডিউটিতে ছিলেন, তিনি আপত্তি করায় ওই ডায়ালিসিস আর করা হয়নি। ১৩ জুন বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পরেই বিভিন্ন মহলে সমালোচনা শুরু হয়। এমন কী বিধানসভাতে ঠাঁই করে নেয় কুকুর-কাণ্ড। নির্মল মাজি, রাজেন পাণ্ডে এবং প্রদীপ মিত্রের নাম মেডিক্যাল রেজিস্টার থেকে বাদ দেওয়ার জন্য জাতীয় মেডিক্যাল কাউন্সিলের কাছে একাধিক দাবিপত্রও যায়।

রাজ্যের এক স্বাস্থ্য-কর্তা বলেন, ‘‘প্রদীপবাবুকে সরানোর সিদ্ধান্তটি এসেছে খোদ নবান্ন থেকে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং স্বাস্থ্যসচিব মলয় দে ছাড়া এই সিদ্ধান্তের কথা সকাল পর্যন্তও কেউ জানতেন না। বদলির চিঠি সই করার সময়ে বিষয়টি জানতে পারেন স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিকর্তা। কেন বিষয়টি নিয়ে এত গোপনীয়তা, বুঝলাম না।’’

প্রদীপবাবু এ দিন স্বেচ্ছাবসরের চিঠি স্বাস্থ্য ভবনে পাঠিয়ে দেওয়ায় চিকিৎসক মহলে প্রশ্ন— বাঙুর ইনস্টিটিউট অব নিউরোলজির প্রাক্তন অধ্যক্ষ শ্যামাপদ গড়াই, নবজাতক চিকিৎসায় বিশেষজ্ঞ অরুণ সিংহের পরে এ বার কি প্রদীপ মিত্রের পরামর্শ থেকেও বঞ্চিত হবেন সরকারি হাসপাতালের রোগীরা?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন