মাদক ছেড়ে ধ্রুপদীর নেশায় মল্লিকার দরবারে

ঠা ঠা রোদে ইটভাটায় কাজ করতে কষ্ট হতো খুব। বয়স তখন মাত্র সাত। মছলন্দপুর ছেড়ে এক দিন ট্রেনে চেপে বসেছিল মুকেশ মণি। তার পর একটানা এগারো বছর তার বাসস্থান ছিল শিয়ালদহ স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম। পরিবেশ-পরিস্থিতির চাপে এ ভাবে অনেক শৈশবই এসে থমকে যায় প্ল্যাটফর্মে।

Advertisement

সুনন্দ ঘোষ

কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ অগস্ট ২০১৫ ০৩:২০
Share:

মুকেশ মণি।—নিজস্ব চিত্র।

ঠা ঠা রোদে ইটভাটায় কাজ করতে কষ্ট হতো খুব। বয়স তখন মাত্র সাত। মছলন্দপুর ছেড়ে এক দিন ট্রেনে চেপে বসেছিল মুকেশ মণি। তার পর একটানা এগারো বছর তার বাসস্থান ছিল শিয়ালদহ স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম।

Advertisement

পরিবেশ-পরিস্থিতির চাপে এ ভাবে অনেক শৈশবই এসে থমকে যায় প্ল্যাটফর্মে। ছোট থেকেই হাতেখড়ি হয় অপরাধের সঙ্গে। একটু বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সমাজ তাদের দেগে দেয় অপরাধী বলে। মুকেশও ভরপুর নেশা করে গুটিয়ে-শুটিয়ে শুয়ে থাকত। বৃষ্টির জলে ধুয়ে যেত ছেঁড়া-ফাটা প্যান্ট-জামা। ঠান্ডা-ভেজা-গরম কোনও বোধই কাজ করত না। শুধু মায়ের কথা মনে পড়লে চোখের জল নেমে আসত চিবুক বেয়ে।

মুকেশের বয়স এখন ২২। এই জুলাই থেকে তিন বছরের জলপানি নিয়ে আমদাবাদে মল্লিকা সারাভাইয়ের কাছে নিয়মিত ধ্রুপদী নৃত্যচর্চা শুরু করেছেন। শিখছেন মার্শাল আর্ট। পড়াশোনাও। মুকেশের প্রতিজ্ঞা, ‘‘আমাকে অনেক বড় হতে হবে। মায়ের দুঃখ দেখেছি। বাবা ছেড়ে চলে গিয়েছে। মায়ের পাশে দাঁড়াতে চাই।’’

Advertisement

কী করে সম্ভব হল এটা?

মনোবিদ জয়রঞ্জন রাম জানাচ্ছেন, প্রতিটি বয়সেই বিবেকের একটা ভূমিকা থাকে। যাঁরা অসৎ কাজে লিপ্ত হয়ে পড়েন তাঁরাও কিছু ভাল কাজ বা মানুষের সংস্পর্শে এলে বদলে যান। মুকেশের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই ঘটেছে। যে সংগঠন তাকে প্ল্যাটফর্ম থেকে তুলে এনেছিল, তারাই দিশা দেখিয়েছে তাকে।

মুকেশ জানিয়েছেন, প্ল্যাটফর্মে থাকার সময়ে কখনও পুলিশ তুলে নিয়ে যেত। বেদম পিটুনির পরে দু’দিন জেলে বিনা পয়সায় খাওয়া। তার পর আবার সেই এক রুটিন— সকালে দূরপাল্লার ট্রেন স্টেশনে থামলে কামরা থেকে তুলে নেওয়া প্লাস্টিক বোতল, খবরের কাগজ। বিক্রি করে দু’চার টাকা। কখনও চোরাগোপ্তা হাত-সাফাই। পকেট কেটে পেয়ে যাওয়া চকচকে নোট। মুকেশের মতো ধুলো-কাদা মাখা ছেলের দল ডুবে যেত মদ-গাঁজা-চরস আর আঠার নেশায়।

২০১১ সালে মুকেশকে তুলে এনে নেশা ছাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছিল একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। তখন মুকেশের বয়স ১৮। নেশায় ডুবে থাকা শিশুদের মুক্তির পথ দেখানো ওই সংগঠনের কর্তা কে বিশ্বনাথের কথায়, ‘‘প্রথম দিকে প্রচণ্ড রেগে থাকত। নেশার জিনিস না পেলে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিত। ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারল।’’ মুকেশ গাড়ি চালানো শিখে নেন দ্রুত। কিছু দিন পরে সুস্থ হয়ে ফিরে যান মায়ের কাছে। ম্যাটাডোর চালিয়ে তখন তাঁর ভালই রোজগার।

এমন অনেক মুকেশকেই তুলে এনে মূলস্রোতে ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে একাধিক সংগঠন। কেউ কেউ অবশ্য নেশা ছাড়তে না পেরে ফিরে যাচ্ছে অতীত জীবনেই। জয়রঞ্জনের কথায়, ‘‘প্রতিটি মানুষের মনেই একটা তুল্যমূল্য বিচার চলে। অনেকে মনে করে সৎ পথে রোজগার করে বেঁচে থাকার চেয়ে সহজে টাকা করাটা অগ্রাধিকার। আবার অনেকে নেশায় ডুবে থেকে অনেক কিছু ভূলতেও চান।’’ বিশ্বনাথের অভিজ্ঞতা কিন্তু বলছে, ‘‘আবার নেশার জগতে ফিরে যাওয়ার সংখ্যাটা মাত্র পাঁচ শতাংশ। অনুকুল পরিবেশ তৈরি করলে, পরিবারের সদস্য বলে স্বীকৃতি দিলে এদের বেশির ভাগই সাধারণ জীবনে ফিরে আসেন।’’ একটু স্নেহ, ভালবাসা, সহমর্মিতা দিয়ে জয় করা যায় তাঁদের মন। অনেকেরই ভিতর থেকে ঠিকরে বেরিয়ে পড়ে সুপ্ত প্রতিভা।

মুকেশের গল্প তাই মছলন্দপুরে গিয়েও শেষ হয় না। নাচের প্রতি ছোট থেকেই ছিল অদম্য আকর্ষণ। টিভি বা সিনেমা দেখে সহজেই রপ্ত করে হয়ে যেত নাচ। নেশা ছাড়ানোর প্রক্রিয়া চলার মাঝেই নাচের তালিম নিচ্ছিলেন মুকেশ। যে সংগঠন সেই তালিম দিত, তার নেত্রী সোহিনী চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘নাচের মাধ্যমে মন-শরীরের উন্নতির সঙ্গে জীবনের একটি দিশাও দেখানো সম্ভব। একে আমরা ড্যান্স মুভমেন্ট থেরাপি বলি।’’ মুকেশও তাদের অন্যতম। তাই ক’দিন পরেই ম্যাটাডোরের স্টিয়ারিং ছেড়ে মুকেশ ফিরে আসেন কলকাতায়। আবার শুরু হয় নাচের তালিম। কলকাতায় এসে মুকেশের নাচ দেখে মুগ্ধ মল্লিকা সারাভাই-এর এক সহকারী তাঁকে টেনে নিয়ে যান আমদাবাদ। শুরু হয় মুকেশের নতুন জীবন। শিল্পীর জীবন।

নেশায় বন্দি মুকেশকে জীবনের নতুন দিশা দেখিয়েছে নাচ। ঠিক যেমন নৃত্যগুরু অলকানন্দা রায়ের প্রশিক্ষণে অন্ধকার অতীতকে মুছে কারাগার থেকে জীবনে ফিরেছেন নাইজেল আকারা। এখনও ভুলতে পারেন না, রবীন্দ্র সদনে প্রথম বার মঞ্চে ওঠার পরে কী ভাবে কেঁদে ফেলেছিলেন হু হু করে! মুকেশের কাহিনি শুনে বললেন, ‘‘নিজেকে দিয়ে জানি, নাচ-গান-ছন্দের মধ্যে দিয়ে সব কষ্ট ভুলে থাকা যায়। মুকেশ সেই পথই তো বেছে নিয়েছে।’’

আর মুকেশের মা রিজিয়া বিবি? কী বলছেন তিনি?

মছলন্দপুরে পথ চেয়ে বসে আছেন ছেলের। বললেন, ‘‘আমাকে আর কাজ করতে দেয় না মুকেশ। বলে, ‘মা তুমি অনেক কষ্ট করেছো। আর না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন