আলোয় রঙিন। দীপাবলির জন্য তৈরি হচ্ছে মোমবাতি। কলকাতার শোভাবাজারে। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী।
বছর দুয়েক আগে দীপাবলির মুখে সল্টলেকে এক বৈঠকে কথাটা বলেছিলেন এক পুলিশকর্তা। তৎকালীন পরিবেশমন্ত্রী সুদর্শন ঘোষদস্তিদারের কাছে ওই পুলিশকর্তার বক্তব্য ছিল, ‘স্যার, শব্দবাজি নিয়ে সরকারি নির্দেশ এত দেরিতে জারি হয় যে, কার্যকর করতে আমরা সমস্যায় পড়ি। ইতিমধ্যেই প্রচুর শব্দবাজি বাজারে ঢুকে গিয়েছে। আপনার বিধানসভা কেন্দ্র মহিষাদল থেকেও ঢুকেছে।’
মন্ত্রী উত্তর দিতে পারেননি।
এ বারও রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের রহস্যজনক গড়িমসি ও টালবাহানায় পুলিশ প্রথমে বুঝতে পারছিল না, কতটা কী করা উচিত। শব্দবাজির বিরুদ্ধে তাই অভিযান আগে শুরু হলেও গতি আসেনি, সাফল্যও তেমন মেলেনি। শেষমেশ আসরে নেমে পরিবেশমন্ত্রী শোভন চট্টোপাধ্যায় স্পষ্ট করে বলেছেন, রাজ্যে এ বারও শব্দবাজি নিষিদ্ধ। কালীপুজোর আর এক সপ্তাহ বাকি। পুলিশ বুঝতে পারছে, ওই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করার দায়িত্ব এখন তাদের ঘাড়ে। তাই এ বার নজিরবিহীন পুলিশি পদক্ষেপের সিদ্ধান্ত কলকাতা-সহ গোটা রাজ্যে।
কলকাতার পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমার বৃহস্পতিবার শহরের প্রত্যেক বিভাগীয় ডিসি-কে শব্দবাজি বাজেয়াপ্ত করার ব্যাপারে ব্যক্তিগত ভাবে উদ্যোগী হতে নির্দেশ দিয়েছেন। এমনটা আগে কখনও হয়নি বলে জানাচ্ছেন লালবাজারের কর্তারা।
একই পদক্ষেপ করা হচ্ছে বাকি রাজ্যেও। রাজ্য পুলিশের এডিজি (আইনশৃঙ্খলা) অনুজ শর্মা বলেন, ‘‘প্রতিটি কমিশনারেট ও জেলার পুলিশ সুপারকে বলা হয়েছে, শব্দবাজি বাজেয়াপ্ত করতে বিশেষ ভাবে উদ্যোগী হতে হবে, কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।’’ তিনি জানান, বাজির কারখানা, গুদাম ও দোকান— সর্বত্র হানা দেওয়া হচ্ছে।
দীপাবলির সন্ধ্যায় বিধাননগরের অনেক বহুতলে দেদার শব্দবাজি ফাটলেও পুলিশ সেই ভাবে ব্যবস্থা নিতে পারে না। এর অন্যতম কারণ, আবাসনের সদর দরজা তালাবন্ধ করে রাখা হয় যাতে পুলিশ ঢুকতে না পারে। এ বার মূল ফটক তালাবন্ধ করে রাখলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে সতর্ক করে দিয়েছে পুলিশ। বিধাননগরের পুলিশ কমিশনার জ্ঞানবন্ত সিংহও সব পুলিশকর্তাকে নিষিদ্ধ বাজি বিক্রি ও ব্যবহারের বিরুদ্ধে কড়া হতে নির্দেশ দিয়েছেন।
মঙ্গলবার সারা বাংলা আতসবাজি উন্নয়ন সমিতির চেয়ারম্যান বাবলা রায় জানিয়েছিলেন, শব্দবাজির মধ্যে শুধু চকোলেট বোমাই ১০০ টন তৈরি হয়ে গিয়েছে। সেই সব নিষিদ্ধ বাজি উদ্ধার এবং সবটুকু উদ্ধার করা সম্ভব না হলেও ব্যবহার যাতে না-হয়, সেটাই নিশ্চিত করতে চাইছে পুলিশ।
কলকাতায় বাজির কারখানা নেই। লালবাজারের বক্তব্য, রাস্তায় বসে যারা বাজি বিক্রি করেন, মূলত তাঁদের একাংশের কাছেই শব্দবাজি গোপনে মজুত করা থাকে। ওই সব ব্যবসায়ীর কিছু গুদামেও ডাঁই করা শব্দবাজি অতীতে উদ্ধার করা হয়েছে, এখনও হচ্ছে। ক্যানিং স্ট্রিট, লেক মার্কেট, বেহালার বীরেন রায় রোডের দু’দিক, গড়িয়া স্টেশনের আশপাশ ও যাদবপুর স্টেশন রো়ড— এই সব তল্লাট শব্দবাজি বিক্রির ঠেক হিসেবে পুলিশের কাছে চিহ্নিত। তবে সতর্ক শব্দবাজির কারবারিরা এ বার অন্য জায়গা বেছে নেবে বলে পুলিশের সন্দেহ। তাই চর মারফত পুলিশ খবর নিচ্ছে, কোথায় শব্দবাজি আছে।
এই উৎসবের মরসুমে শুক্রবার সকাল পর্যন্ত কলকাতা পুলিশ ২১০২ কেজি নিষিদ্ধ বাজি উদ্ধার করেছে, গ্রেফতার করা হয়েছে ৯৩৩ জনকে। তবেএর মধ্যে শুধু বৃহস্পতিবার থেকে শুক্রবার সকাল পর্যন্ত উদ্ধার করা হয়েছে ১৬৪৫ কেজি, ধৃতের সংখ্যা ১৫৪। যা থেকে স্পষ্ট, যাবতীয় শব্দবাজিকে নিষিদ্ধ বলে পরিবেশমন্ত্রী বৃহস্পতিবার ঘোষণা করার পর থেকেই তল্লাশি অভিযানে আরও গতি এসেছে। তবে শুধু গতি নয়, শব্দবাজি ধরতে নতুন কৌশলও প্রয়োগ করার কথা ভেবেছে পুলিশ।
লালবাজার সূত্রের খবর, যে পরিমাণ নিষিদ্ধ বাজি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে, তার ৭০ শতাংশই শব্দবাজি। সেগুলোর বেশির ভাগ তৈরি হয়েছে এই রাজ্যেই, অল্প কিছু এসেছে তামিলনাড়ুর শিবকাশী থেকে।
লালবাজারের এক কর্তা বলেন, ‘‘৭০ শতাংশ শব্দবাজি উৎপাদকদের ঘর থেকে বাজারে ঢুকে পড়েছে। কিন্তু অভিজ্ঞতা বলছে, বাকি বাজি এখনও প্রস্তুতকারকদের ঘরে, ছাদের নীচে মাচা করে রাখা।’’ কলকাতা পুলিশ অবশ্য শহরের বাইরে গিয়ে অভিযান চালানোর ব্যাপারে এখনও সিদ্ধান্ত নেয়নি। তবে লাগোয়া জেলা পুলিশ ও কমিশনারেটগুলোকে সেটা করতে বলা হয়েছে।
রাজ্য পুলিশের এক কর্তার কথায়, ‘‘শব্দবাজিকে সরকারি ভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার ব্যাপারটা এক রকম। কিন্তু তার সঙ্গে শব্দবাজির দাপট থেকে সাধারণ মানুষকে রেহাই দিতে পারার তফাত রয়েছে। আমাদের একাই সেটাই নিশ্চিত করতে হবে।’’