সন্ত্রাসের আঁতুড় থেকেই আলো

বাতিল হয়ে গিয়েছিল মাধ্যমিকের টেস্ট পরীক্ষা। গোলাগুলির আতঙ্কের জেরে, নিত্য ছুটিও হয়ে গিয়েছিল একরকম রুটিন। সব স্কুল যখন গরমের ছুটি বা পুজোর ছুটিতে মেতে থকত, কেবল তখন চলত ক্লাস। বোমা-বারুদ আর নিত্য সংঘর্ষের শিরোনামকে সঙ্গে নিয়েই পরীক্ষায় ভাল ফল করে নজির গড়ল আমিরুল ইসলাম, শেখ রিয়াজুদ্দিন, দেবদত্ত চট্টোপাধ্যায়, সুষ্মিতা মুখোপাধ্যায়, ঈসিকা চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। ওদের সকলেরই বাড়ি পাড়ুই থানার সাত্তোর এলাকা।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

পাড়ুই শেষ আপডেট: ০২ জুন ২০১৫ ০০:০১
Share:

যাদবপুরে বান্ধব উচ্চ বিদ্যালয়ে ছুটির দিনেও চলছে ক্লাস। —নিজস্ব চিত্র।

বাতিল হয়ে গিয়েছিল মাধ্যমিকের টেস্ট পরীক্ষা। গোলাগুলির আতঙ্কের জেরে, নিত্য ছুটিও হয়ে গিয়েছিল একরকম রুটিন। সব স্কুল যখন গরমের ছুটি বা পুজোর ছুটিতে মেতে থকত, কেবল তখন চলত ক্লাস। বোমা-বারুদ আর নিত্য সংঘর্ষের শিরোনামকে সঙ্গে নিয়েই পরীক্ষায় ভাল ফল করে নজির গড়ল আমিরুল ইসলাম, শেখ রিয়াজুদ্দিন, দেবদত্ত চট্টোপাধ্যায়, সুষ্মিতা মুখোপাধ্যায়, ঈসিকা চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। ওদের সকলেরই বাড়ি পাড়ুই থানার সাত্তোর এলাকা।

Advertisement

পাড়ুই থানা এলাকায় বোমাবাজি এবং গুলিগোলার খবর নতুন নয়। কার্যত এই এলাকার বাসিন্দাদের ঘুম ভাঙে বোমা গুলির লড়াই শুনে। আবার স্থানীয়রা ঘুমোতে যান সেই একই শব্দে। যার জেরে, মাধ্যমিকের টেস্ট পরীক্ষাও বাতিল হয়। পরীক্ষার দিনক্ষণ পরে ঠিক হলেও, বিদ্যালয় পরিচালন সমিতি থেকে শুরু করে প্রশাসনকে পর্যন্ত ভাবিয়ে তুলেছিল। এলাকার পড়ুয়াদের নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে, কোথাও কোথাও বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দীর্ঘ কাল ছুটি ঘোষণা করেছে, তেমন নজিরও রয়েছে। খবরের শিরোনামে হররোজ জায়গা করে নেওয়া একটি জায়গা থেকে পরীক্ষায় ভাল ফল করলে অবাক হতেই হয়। ঘটনা হল, ছুটির সময় ক্লাস করে, বিরুদ্ধ পরিবেশে লড়াই করতে করতেই হাতে নাতে ফল পেয়েছেন এলাকার পড়ুয়ারা।

ছাত্রছাত্রীদের এই সাফল্য মিলেছে যাদবপুর বান্ধব উচ্চ বিদ্যালয়, হাঁসড়া উচ্চ বিদ্যালয়, বাতিকার অভেদানন্দ উচ্চ বিদ্যালয়ের মতো সন্ত্রাস কবলিত এলাকার বেশ কয়েকটি স্কুলে। যাদবপুর বান্ধব উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক চিত্তরঞ্জন ঘোষ বলেন, “এ বার মাধ্যমিকে মোট পরীক্ষার্থী ৭২, উত্তীর্ণ ৭১। ৭৫ শতাংশের বেশি নম্বর পেয়েছে ৬ পড়ুয়া।” বিদ্যালয় সূত্রে জানা গিয়েছে, বাংলা মাতৃভাষা হলেও, আর পাঁচটা স্কুলের মতো এই বিষয়ের প্রতি পড়ুয়াদের অতীতে ভীতি ছিল এই বিদ্যালয়েও। কিন্তু বর্তমান সেখানে ১১ জন পেয়েছেন ‘লেটার মার্ক্স’। চিত্তরঞ্জনবাবু বলেন, “লেটার নম্বরের তালিকায় রয়েছে, জীবন বিজ্ঞান ১৪, ইতিহাসে ৭, ভৌতবিজ্ঞান ৬ , গণিতে ৬, ভূগোলে ৪ এবং ইংরাজিতে ১ জন।”

Advertisement

একে প্রত্যন্ত এলাকা আবার ‘সন্ত্রাস’ কবলিতও বটে। কী ভাবে সম্ভব হল এমন ফল? বিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা এবং শিক্ষকেরা বলেন, সদ্য প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক প্রদীপ কুমার মণ্ডল এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চালু করেছিলেন ‘বিশেষ ব্যবস্থা’। আর সেই ‘বিশেষ ব্যবস্থার’ জন্যই, বরাবর তুলনামূলক ভাবে ভাল ফল করছে যাদবপুর বান্ধব উচ্চ বিদ্যালয়। বিদ্যালয় এবং অভিভাবকদের সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রত্যন্ত এলাকার এই স্কুলের বেশির ভাগ ছাত্রছাত্রী আর্থ সামাজিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া শ্রেণির। কোনও কোনও বাড়িতে আবার প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়া। বিদ্যালয়ে রয়েছে, সংখ্যা লঘু সম্প্রদায়, তপসিলি জাতি, জনজাতি এবং অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির পড়ুয়াদের হার বেশি।

এর সঙ্গে রয়েছে কারণে-অকারণে এলাকায় বচসা, গণ্ডগোল থেকে বোমাবাজি এবং গুলির লড়াইতে এলাকাজুড়ে সন্ত্রাসের কালোছায়া। অভিভাবকরা নিজের গাঁটের কড়ি খরচ করে পড়ুয়াদের বিদ্যালয়মুখী করার জন্য, প্রত্যেক শ্রেণিতে চালু হয়েছিল সর্বোচ্চ উপস্থিতির জন্য তিনটি করে পুরষ্কার। পড়ুয়াদের পঠন পাঠনে উন্নতির জন্য, তাদের সাহিত্য ও সংস্কৃতির চর্চা এবং বিকাশের প্রয়োজনীয়তার কথা মাথায়ে রেখে, ফি সপ্তাহে স্কুলে চালু হয়েছিল ‘শিক্ষা সপ্তাহ’। বিদ্যালয়ের পঠন পাঠনের পাঠ্যক্রমের বাইরে, পড়ুয়াদের মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক চর্চা করানো হত। এই সমস্ত পদক্ষেপ থেকেই ফল ভাল হয়েছে, এমন মনে করছেন তাঁরা।

বোমা-বারুদের এলাকায় এমন রেজাল্ট নিয়ে বাংলার শিক্ষক কল্যাণ মুখোপাধ্যায় বললেন, ‘‘স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে বন্ধুর মতো মেলামেশা করে, তাঁদের সমস্যার কথা আমরা খুঁজে বের করি। সকলের সঙ্গে আলোচনা করে, সমাধানের চেষ্টা করি। সে পঠন পাঠন সংক্রান্ত বিষয় হোক অথবা পারিবারিক। কখনও শিক্ষক তো কখনও আবার অভিভাবকের কাজ করতে হয়।” যাঁর হাত ধরে যাদবপুরের বিদ্যালয়ে পঠন-পাঠন বদলে যায়, সদ্য প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক প্রদীপকুমার মণ্ডল অবশ্য ততটা উচ্ছসিত নন। তিনি বলেন, “১৭ বছর আগে যখন স্কুলে কাজে যোগ দিই, তখন ভেবেছিলাম পালিয়ে যাব। অভিভাবক, এলাকার বাসিন্দারা আন্তরিক ভাবে বলেছিলেন, ‘স্কুলটা তৈরি করো’। যেতে পারিনি। সকলের সহযোগিতা নিয়ে, শুরু হয়েছিল উদ্যোগ। একাধিক বার মাধ্যমিকে ১০০ তে ১০০ নম্বর পেয়েছে এখানকার পড়ুয়ারা। মাস আটেক হল, বিদ্যালয় থেকে স্থানান্তর হয়েছি ঠিকই, কিন্তু মন তো পড়ে আছে যাদবপুর বান্ধব উচ্চ বিদ্যালয়ে।’’

এলাকার অন্য স্কুলের কোনও কোনও শিক্ষক অবশ্য বলছেন, এলাকায় শান্তি ফিরলে হয়তো আরও ফল ভাল হত। হাঁসড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও বাতিকার অভেদানন্দ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অপূর্ব চক্রবর্তী, প্রদীপ কুমার ঘোষরা জানালেন, এলাকায় শান্তি থাকলে ফল আরও ভাল হত। শিরোনামে বোমা-বারুদের গ্রাম থেকে কৃতীর গ্রাম হিসাবে দেখতে চায় এলাকার ছোটরাও। দশম শ্রেণির সুমনা হেমব্রম, সঞ্চিতা ঘোষ, মন্দিরা সূত্রধরদের পাশাপাশি রাহুল গড়াই, সুমন সাহা, সায়ন বন্দ্যোপাধ্যায় ও শেখ জসিমুদ্দিনদের দাবি তেমনই। তাদের দাবি, ‘‘পাড়ুই-সাত্তোর সন্ত্রাসের গ্রাম হিসাবে নয়, শিরোনামে আসুক শিক্ষাক্ষেত্রে সফলতার জন্য।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন