নিরুদ্দেশের সংসার

প্রিয়জনের আশা ছেড়ে কঙ্কালই চায় ভুখা পেট

ঘোমটার আড়াল থাকলেও বোঝা গেল, চোয়াল শক্ত হয়ে গিয়েছে। ক্রমাগত জল বেরোতে বেরোতে চোখ জোড়া রুক্ষ। সেই শুকনো চোখে, ঠান্ডা গলায় ঝর্না সিংহ বললেন, “তিন বছর আলতা-সিঁদুর পরছি না। ওকে মেরে ফেলেছে ওরা। সেটা জানার পরে তো আর সধবা সেজে থাকতে পারি না।’’ কিন্তু ঝর্নার স্বামী মোহন তো এখনও ‘সরকারি ভাবে’ মৃত নন! লালগড় থানার নথি মোতাবেক, ধরমপুরের শালবনি গ্রামের মোহন সিংহ ২০০৯-এর ১৪ জুনে মাওবাদীদের হাতে অপহৃত হন, আর সেই ইস্তক তিনি নিখোঁজ।

Advertisement

সুরবেক বিশ্বাস

লালগড় শেষ আপডেট: ০৬ মে ২০১৫ ০৪:১৬
Share:

ঝর্না সিংহ, নিছু সামন্ত এবং কল্যাণী দাস। ছবি: দেবরাজ ঘোষ।

ঘোমটার আড়াল থাকলেও বোঝা গেল, চোয়াল শক্ত হয়ে গিয়েছে। ক্রমাগত জল বেরোতে বেরোতে চোখ জোড়া রুক্ষ।

Advertisement

সেই শুকনো চোখে, ঠান্ডা গলায় ঝর্না সিংহ বললেন, “তিন বছর আলতা-সিঁদুর পরছি না। ওকে মেরে ফেলেছে ওরা। সেটা জানার পরে তো আর সধবা সেজে থাকতে পারি না।’’

কিন্তু ঝর্নার স্বামী মোহন তো এখনও ‘সরকারি ভাবে’ মৃত নন! লালগড় থানার নথি মোতাবেক, ধরমপুরের শালবনি গ্রামের মোহন সিংহ ২০০৯-এর ১৪ জুনে মাওবাদীদের হাতে অপহৃত হন, আর সেই ইস্তক তিনি নিখোঁজ। তা হলে?

Advertisement

খড়ের ছাউনি দেওয়া মাটির ঘরে অভাব যেন হাঁ করে গিলতে আসছে। দিনমজুর ঝর্না জানালেন, তিন বছর আগে কদমখণ্ডি গ্রামের পশ্চিমে কংসাবতীর পাড়ে মাটি খুঁড়ে একটা কঙ্কাল বেরিয়েছিল, যেটা তাঁর স্বামীরই। কী ভাবে নিশ্চিত হলেন? দুই কিশোর ছেলের মা ঝর্নার যুক্তি, মাওবাদীরা তুলে নিয়ে যাওয়ার আগে হাতির তাড়া খেয়ে পালাতে গিয়ে মোহনের ডান পা ভেঙে যায়। ধাতব পাত বসিয়ে অপারেশন হয়। কঙ্কালের ডান পায়েও ছিল ধাতব পাত। ডিএনএ পরীক্ষার জন্য রক্ত-চুল-নখের নমুনা দিলেও রিপোর্ট এখনও জানেন না ঝর্নারা। তাঁর সাফ কথা, “কঙ্কালটা ওঁরই। দাঁত দেখেও বুঝেছিলাম। এত বছর ঘর করেছি, বুঝব না!”

পাশের গ্রাম জিরাপাড়ার কল্যাণী ও পুষ্প দাসও বিধবার জীবন যাপন করছেন। সম্পর্কে তাঁরা জা। কল্যাণীর স্বামী সুনীল ও পুষ্পর স্বামী তপনকে মাওবাদীরা ১৪ জুন মোহন সিংহের সঙ্গেই তুলে নিয়ে যায় বলে অভিযোগ রয়েছে পুলিশের কাছে। দুই ভাইয়ের দেহ বা দেহাবশেষ— কিছুই মেলেনি। ডুকরে ওঠা কান্না আঁচলে চাপা দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে কল্যাণীর প্রশ্ন, “ও কি আর আছে? থাকতে পারে?” পুষ্পেরও এক কথা— ‘‘নেই, নেই, বেঁচে নেই। থাকলে এতগুলো বছরে অন্তত এক বার খোঁজ পেতাম।” সুনীল-তপনের বৃদ্ধা মা বেলারানি দাসের অস্ফূট স্বগতোক্তি, “ছ’-ছ’টা বছর কাটতে চলল। ওদের তো শেষই করে দিয়েছে।”

পড়শি অসিত সামন্তও নিখোঁজ। এবং তাঁর স্ত্রী নিছু দেবীও একই রকম প্রত্যয়ে স্বেচ্ছায় বিধবার বেশ নিয়েছেন। “আমি বিধবা। এটাই সত্যি। মিথ্যে আশায় থেকে কষ্টই শুধু বাড়বে।”— আবেগহীন পাথুরে গলায় মন্তব্য প্রৌঢ়ার। লালগড়ের আট কিলোমিটার দক্ষিণে গা ঘেঁষাঘেষি দুই গাঁয়ের জনা দশ-বারো ‘নিখোঁজ’ বাসিন্দার সংসারে মোটামুটি একই ছবি। নিখোঁজদের প্রায় প্রত্যেকেই ছিলেন বাড়ির একমাত্র রোজগেরে। তাই ঘোর গ্রীষ্মের গনগনে তাপের চেয়েও পরিজনদের কাছে দুঃসহ হয়ে উঠেছে দারিদ্র্যের জ্বালা।

যেমন নাড়ু সামন্তের পরিবার। মোহন-সুনীল-অসিতদের সঙ্গে অপহৃত নাড়ুর স্ত্রী প্রতিমা দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে প্রায় দিন এক বেলা উপোস দিচ্ছেন। অন্য বেলার খাবার বলতে জঙ্গলমহলের জন্য বরাদ্দ দু’টাকা কেজি চালের সঙ্গে পোকাধরা বেগুন, সঙ্গে হয়তো সামান্য শাক-পাতা। কাঁটাপাহাড়ির বরাগাদা গ্রামের সদানন্দ প্রতিহারের স্ত্রী রুমা জানান, ২০১০-এর ১৯ মে তাঁর স্বামীকে বাঁশবেড় গ্রাম থেকে তুলে নিয়ে যায় মাওবাদীরা। দেহ না-মেলায় ‘সরকারি’ ভাবে রুমা বিধবা নন। বিধবা ভাতাও পাচ্ছেন না। আট বছরের ছেলে নিখিলকে বুকে জড়িয়ে ওঁর আকুল প্রশ্ন, “বলুন তো, মা-ছানা খাব কী?’’

খাতায়-কলমে লালগড়ে সদানন্দ প্রতিহারের মতো ‘নিখোঁজ’ ব্যক্তির সংখ্যা কমপক্ষে ৩০। প্রায় সকলেরই পরিবার মেনে নিয়েছে, প্রিয়জন বেঁচে নেই। কিন্তু হতদরিদ্র পরিবারগুলোর ন্যূনতম ভাত-কাপড়ের সংস্থানের জন্য যে সরকারি ক্ষতিপূরণ বরাদ্দ, তার দেখা নেই। কেননা ‘সরকারি’ ভাবে ওঁরা মারা যাননি। যে যুক্তির গেরোয় ধরমপুরের সরকারি গ্রন্থাগারের অবসরপ্রাপ্ত কর্মী কেশব মানার নামে কানাড়া ব্যাঙ্কের চামিটাড়া শাখায় ফি মাসে পেনশনের সাড়ে তিন হাজার টাকা জমা হলেও স্ত্রী শান্তিদেবী একটা পয়সাও তুলতে পারছেন না!

তবে গত ১ মে ভোরে ভুলাগাড়ার জঙ্গলে উদ্ধার দু’টি কঙ্কাল কনস্টেবল কাঞ্চন গড়াই ও সাবির আলি মোল্লার বলে পুলিশ মোটামুটি নিশ্চিত ভাবে দাবি করায় ‘নিখোঁজ’দের বাড়ির লোক কিছুটা আশায় বুক বেঁধেছেন। যদিও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা পুলিশের এক কর্তা ঠারেঠোরে স্বীকার করেছেন যে, সাবির-কাঞ্চন পুলিশকর্মী হওয়ার সুবাদেই ওঁদের দেহাবশেষ উদ্ধারে পুলিশ তত্‌পরতা দেখিয়েছে। অন্যদের ক্ষেত্রে তা দেখা যাবে কি না, তা নিয়ে পুলিশের অন্দরেই কিছুটা সংশয়। রাজ্য পুলিশের এক শীর্ষ কর্তার অবশ্য দাবি, “যেমন তথ্য আসছে, অপহৃতদের দেহ উদ্ধারে তেমনই পদক্ষেপ করছি।” তাই বলে দুর্বিপাক কি থেমে থাকবে? শালবনির ‘নিখোঁজ’ কেশব মানার একমাত্র ছেলে দেবরাজ ২৩ এপ্রিল হৃদ্‌রোগে মারা গিয়েছেন। ছ’বছর আগে কেশববাবুর সঙ্গে মাওবাদীরা তাঁর ভাইপো ধীরজকেও তুলে নিয়ে যায়। “বাবা-ভাইয়ের খোঁজ না-পেয়ে ছেলেটা গুমরে থাকত। হঠাত্‌ হার্ট অ্যাটাক। চার ঘণ্টায় সব শেষ।”— ধরা গলায় জানালেন দেবরাজের কাকা জগত্‌বাবু।

স্কুল-কলেজ-হস্টেল, সেতু, ঝকঝকে রাস্তা। জঙ্গলমহলের‘হাসি মুখের’ আড়ালে চাপা পড়ে আছে নিহত, থুড়ি নিখোঁজদের পরিজনের কান্না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন