আনন্দের অর্ঘ্যেই যৌনতার সৎকার

কখনও কখনও ভারতীয় ভাষাসাহিত্য সর্বভারতীয় রাজনীতিকে অতিক্রম করে যায়। শনিবার বিকেলে ‘হলদে গোলাপ’ উপন্যাসের জন্য ১৪২১ সালের আনন্দ পুরস্কারে সম্মানিত স্বপ্নময় চক্রবর্তী তাঁর বক্তৃতার শেষ ভাগে জানালেন, ‘গত কালই ট্রান্সজেন্ডারদের সমান অধিকার নিয়ে সংসদে বিল পাশ হয়েছে।’ শুক্রবার সংসদে রূপান্তরকামীদের অধিকার নিয়ে ডিএমকে সাংসদ তিরুচি শিখার আনা প্রাইভেট মেম্বার্স বিল পাশ হওয়ার কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন তিনি।

Advertisement

গৌতম চক্রবর্তী

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:১৮
Share:

স্বপ্নময় চক্রবর্তীর হাতে ১৪২১ বঙ্গাব্দের আনন্দ পুরস্কার তুলে দিচ্ছেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। রয়েছেন আনন্দবাজার পত্রিকার প্রধান সম্পাদক অভীক সরকার। শনিবার। —নিজস্ব চিত্র।

কখনও কখনও ভারতীয় ভাষাসাহিত্য সর্বভারতীয় রাজনীতিকে অতিক্রম করে যায়। শনিবার বিকেলে ‘হলদে গোলাপ’ উপন্যাসের জন্য ১৪২১ সালের আনন্দ পুরস্কারে সম্মানিত স্বপ্নময় চক্রবর্তী তাঁর বক্তৃতার শেষ ভাগে জানালেন, ‘গত কালই ট্রান্সজেন্ডারদের সমান অধিকার নিয়ে সংসদে বিল পাশ হয়েছে।’ শুক্রবার সংসদে রূপান্তরকামীদের অধিকার নিয়ে ডিএমকে সাংসদ তিরুচি শিখার আনা প্রাইভেট মেম্বার্স বিল পাশ হওয়ার কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন তিনি। পাঁচতারা হোটেলের বলরুম ভেসে গেল উচ্ছসিত করতালিতে। মানবাধিকার সংগঠন এবং সমাজকর্মীদের ক্ষুদ্র বৃত্তের বাইরে সাহিত্য পুরস্কারের আলোময় জগতেও এল ট্রান্সজেন্ডার-স্বীকৃতি।

Advertisement

এই স্বীকৃতি পরিশ্রমী লেখকের। স্বপ্নময়ের উপন্যাস তো শুধু দুই প্রজন্মের, দুই মেরুর হিজড়ে ও ট্রান্সজেন্ডারের জীবন নয়। সেখানে এসেছে জিনতত্ত্ব, ক্লাইনফেল্টার, টার্নার সিনড্রোম, ক্রোমোজোমের খামখেয়ালিপনা ইত্যাদি অনেক কিছু। ‘‘এই পরিশ্রমী নিষ্ঠা থেকে কেবল সাহিত্যিক নয়, অন্য বাঙালিদেরও শেখার আছে,’’ প্রারম্ভিক ভাষণে বলছিলেন আনন্দবাজার পত্রিকার প্রধান সম্পাদক অভীক সরকার।

এই পরিশ্রম নতুন বিষয়ের জন্য। সেক্স চেঞ্জ বিষয়টিই চিকিৎসাশাস্ত্রে মাত্র কয়েক দশকের পুরনো, ফলে বাংলা উপন্যাসে সে ভাবে আসেনি তার কথা। মানপত্রেও সেই সত্যবদ্ধ অঙ্গীকার, ‘প্রসঙ্গটি বাংলা কথাসাহিত্যে হয় নৈঃশব্দ দ্বারা অথবা ঊনকথনে আবৃত ছিল।’ স্বপ্নময় হাল আমলের বাংলা তথা ভারতীয় সাহিত্যে সেই নৈঃশব্দ এবং ট্যাবু ভেঙেছেন। রূপান্তরকামী পুরুষের কৃত্রিম স্তন প্রতিস্থাপন যে মাত্র কয়েক ঘন্টার অপারেশন, তা জানিয়েছে উপন্যাসের অন্যতম নায়ক পরি।

Advertisement

এবং এটিই প্রথম। এর আগে বাংলা উপন্যাসের জগতে লেখা হয়নি মার্কিন লেখক গোর ভাইডালের ‘মাইরা ব্রেকিনরিজ’-এর মতো উপন্যাস। নায়িকা মাইরা তার এক ছাত্রকে ধর্ষণ করে, পরে গাড়ি দুর্ঘটনার শিকার হয়। বোঝা যায়, মাইরা আসলে মাইরন নামে এক পুরুষ। দুর্ঘটনার ফলে তার ব্রেস্ট ইমপ্লান্ট নষ্ট হয়ে যায়, হরমোন থেরাপি আর কাজে আসে না। একদা গণবিজ্ঞান আন্দোলনের কর্মী স্বপ্নময়ের এ দিনের বক্তৃতাতেও ভেসে এল অলডাস হাক্সলে থেকে টিন্ডাল, স্পেন্সার, বাংলার আশীষ লাহিড়ীর মতো বিজ্ঞান-দার্শনিকদের কথা। পঞ্জিকায় ছাপা জামাইষষ্ঠীর ছবির কথা বলছিলেন লেখক, ‘জামাই চর্বচোষ্য খাবারের সামনে, শাশুড়ি পাখার বাতাস করছেন, পাশের ঘর থেকে উঁকি মারে একটি বউ। সেই বউটিই হল বিজ্ঞান। এখন সময় পাল্টাচ্ছে, কিন্তু এত দিন সাহিত্যের ঘরে তার প্রবেশাধিকার ছিল না।’ বিজ্ঞান এবং সাহিত্যকে এ ভাবে জুড়ে দিতে পারেন যাঁরা, তাঁরা নিছক বাঙালি নন, আধুনিক ভারতীয় সাহিত্যের স্রষ্টা। অমিতাভ ঘোষের ‘হাংরি টাইড’ না থাকলে বাঙালি আদৌ জানত, এ বঙ্গের গাঙ্গেয় শুশুক আর মায়ানমারের ইরাবতীর শুশুক আসলে মাসতুতো-পিসতুতো ভাই?

অনুষ্ঠানে পৌরোহিত্য করতে এসে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় তাঁর মনোগ্রাহী বক্তৃতায় নিয়ে এলেন লেখকের রান্নাঘর। ‘লেখকের কাজ জীবনের আনাচেকানাচে অতি তুচ্ছ বর্জ্যগুলি জোগাড় করে, তার মধ্যে দিয়ে সত্য আবিষ্কার।’ বহু যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতার রকমফেরে স্বপ্নময় চক্রবর্তীর সত্য আবিষ্কার কি আজকের কথা? তিন দশক আগে দেশলাই কোম্পানির এক সেল্স এগজিকিউটিভকে তাঁর ওপরওয়ালা দিন কয়েকের জন্য বিহারশরিফে পাঠিয়েছিলেন। এগজিকিউটিভ দেশলাই বিক্রির স্টক না মিলিয়ে, হোলসেলারদের সঙ্গে কথা না বলে সটান নালন্দা দেখতে চলে যান। অতীতের বিশ্ববিদ্যালয়টি তখনও তাঁর দেখা হয়নি। নালন্দা থেকে ফিরে দেখেন, হোটেলের ঘরে ওপরওয়ালা স্বয়ং। চাকরিটা তৎক্ষণাৎ চলে যায়। সে দিন নালন্দা দেখতে গিয়েছিলেন বলেই আজও স্বপ্নময়ের বক্তৃতায় ভেসে আসে বৌদ্ধ আলঙ্কারিক অভিনবগুপ্তের কথা, ‘আনন্দ হল চৈতন্যের আবরণভঙ্গ।’

আর, লেখকের সত্য আবিষ্কারের পথ ধরেই নিজের সংস্কার এবং বোধকে প্রশ্ন করেন পাঠক। তাই অভিজ্ঞানপত্র জানিয়েছে, ‘সামাজিক লিঙ্গনির্মিতির প্রসঙ্গ ছাপিয়ে আপনার উপন্যাস পাঠককে বাধ্য করে নিজের অভ্যস্ত বোধ ও নীতিকে প্রশ্ন করতে।’ এক দশক আগে জাপানি ঔপন্যাসিক মুরাকামির ‘কাফকা অন দ্য শোর’ উপন্যাসের ট্রান্সজেন্ডার লাইব্রেরিয়ান চরিত্র ওশিমা এ ভাবেই তো বদলে দিয়েছিল আমাদের বোধ। নায়ককে সে বলেছিল, ‘শিল্পী তারাই, যারা অতিকথন এড়িয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে।’ প্রধান সম্পাদকও তাঁর বক্তৃতায় বাঙালির স্বভাবগত আলস্য এবং অসংযমের কথা বলছিলেন। ফেনায়িত আবেগ আর অতিকথন যে আলস্যের অন্য পিঠ। উপন্যাসের কাল্পনিক ট্রান্সজেন্ডারদের নিয়ে যে ভাবে জাপান থেকে বাংলা সকলেই অতিকথনমুক্ত হতে চায়, সেখানে কি নেই সাহিত্যদুনিয়ার নতুন কোনও ‘লুক ইস্ট’ অভিজ্ঞান?

থাকবে নাই বা কেন! সেক্স চেঞ্জ একেবারে প্রাচ্য দর্শন। গ্রিক উপকথায় টাইরেসিয়াসের কাছে দেবরাজ জিউস ও তাঁর স্ত্রী হেরা এসে প্রশ্ন করেন, ‘সঙ্গমে কার আনন্দ বেশি।’ টাইরেসিয়াস নারীর কথা বললে হেরা রেগে তাঁকে মেয়েকে পরিণত করে দেন। জিউস পরে তাঁকে আবার পুরুষ করে দেন। আর ভারতীয় স্কন্দপুরাণে হরপার্বতীর পূজারিণী সোমবন নামে এক ব্রাহ্মণসন্তানকে নারীতে রূপান্তরিত করে দেন। ব্রাহ্মণ কান্নাকাটি করলেও শিব অনড়, ‘আমার ভক্তর কথায় এটি হয়েছে। তাই নড়চড়ের ক্ষমতা আমার নেই।’ ভক্তের কথায় লিঙ্গ পরিবর্তন ঘটে গেলে মেনে নিতেই হবে। স্বয়ং ঈশ্বরেরও সেটি ওলোটপালোটের ক্ষমতা নেই।

লেখকও তো নন স্বয়ম্ভূ ঈশ্বর! লিঙ্গপরিচয়ের সঙ্কট থেকে সরে এসে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বলছিলেন, ‘স্বপ্নময় ঢাকা দেওয়া অবাঞ্ছিত সত্যের উন্মোচন করা এক সচেতন লেখক। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি যত এগোবে, সাহিত্যের ভাষাও বদলাবে।’ বাংলা সাহিত্যে ট্রান্সজেন্ডার বা লিঙ্গনির্মাণের ক্রান্তিকাল নয়, শনিবারের আনন্দসন্ধ্যা ছিল আক্ষরিক অর্থেই যৌনতার সৎকার।

পরিশ্রমবিমুখ, ভাষা-উদাসী বাঙালি ভুলে গিয়েছে, সৎকার মানে স্রেফ মড়া পোড়ানো নয়। সংস্কৃতে শব্দটির প্রধান অর্থ: পুজো। সেক্স চেঞ্জ নিয়ে জনপ্রিয় লেখকের প্রথম বাংলা উপন্যাসের সম্মানে সেই পূজার্ঘ্যই প্রতিষ্ঠিত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন