বন্দরের প্রণামি গুনেই তাপসের এই বাড়বাড়ন্ত

হাত পাকিয়েছিল সাইকেল চুরি দিয়ে। তাপসের তখন নবম শ্রেণি। ১৯৮৬ সালে সেই অভিযোগের পরে আর স্কুলমুখোই হয়নি ছেলেটি। উঠতি বয়সের ছেলের মতিগতি দেখে সামান্য নিরাপত্তারক্ষী বাবার দুশ্চিন্তার সেই শুরু।

Advertisement

শুভাশিস ঘটক

ডায়মন্ড হারবার শেষ আপডেট: ১২ মে ২০১৬ ০৩:২৯
Share:

আয়েসে। তাপস মল্লিক। — ফাইল চিত্র।

হাত পাকিয়েছিল সাইকেল চুরি দিয়ে। তাপসের তখন নবম শ্রেণি। ১৯৮৬ সালে সেই অভিযোগের পরে আর স্কুলমুখোই হয়নি ছেলেটি। উঠতি বয়সের ছেলের মতিগতি দেখে সামান্য নিরাপত্তারক্ষী বাবার দুশ্চিন্তার সেই শুরু।

Advertisement

তিরিশ বছর পরে সেই ছেলের এখন নীল রঙের তিনমহলা বিশাল প্রাসাদ দেখে হাঁ হয়ে যায় গাঁয়ের মানুষ। গোটা তল্লাটে অমন পেল্লায় চেহারার বাড়ি আর চোখে পড়ে না। তাপসের সেই প্রাসাদের গাড়িশালে শোভা পায় সাদা রঙের ইন্ডিকা, কালো মোটর বাইক। বাইক চললে পতপত করে ওড়ে সামনে লাগানো তৃণমূলের পতাকা। গাড়ির সামনে রাখা থাকে তৃণমূলের বিভিন্ন সম্মেলনে যোগ দিয়ে পাওয়া স্বেচ্ছাসেবকের ‘ব্যাজ’। দাপট দেখে চাপে থাকেন পুলিশকর্মীরাও। মোষ-চুরির অপবাদ দিয়ে কলেজছাত্রকে পিটিয়ে খুনের ঘটনায় মূল অভিযুক্ত হওয়া সত্ত্বেও যে কারণে এখনও অধরাই থেকে যায় তৃণমূল নেতা তাপস মল্লিক।

হরিণডাঙা পঞ্চায়েতের তৃণমূল সদস্য তাপস এখন এলাকার মুকুটহীন রাজা। অভিযোগ, ডায়মন্ড হারবার বন্দরে ঠিকাকর্মী সরবরাহ থেকে শুরু করে এলাকার তোলাবাজির কলকাঠি তারই হাতে।

Advertisement

তাপসের প্রভাব-প্রতিপত্তি মনে করায় হালিশহরের রাজা দত্তের কথা। রাজার মতোই তাপসের মাথাতেও রয়েছে স্থানীয় বিদায়ী বিধায়কের হাত, কানাঘুষো এমনটাই। বন্দরের কোটি টাকার তোলাবাজির একাংশ এই তাপসের হাত দিয়েই দলের উপর তলায় পৌঁছে যায় বলে অভিযোগ বিরোধীদের। গণপিটুনিতে খুনের ঘটনায় নাম জড়ানোয় একে একে তাপসের কীর্তি সামনে আসতে শুরু করেছে। ঠিক যেমন ভোটের আগের রাতে ভোটারের বাড়িতে হামলা চালিয়ে, শিশুকন্যাকে মারধর করে খবরের শিরোনামে এসেছে হালিশহরের রাজা দত্ত।

তাপসের ‘উন্নতি’র সিঁড়ির হদিস খুঁজতে গিয়ে কথা হচ্ছিল স্থানীয় এক পুলিশকর্তার সঙ্গে। জানালেন, স্কুল ছাড়ার কিছু দিন পরে তাপস ডায়মন্ড হারবারে স্টুডিও খুলে ব্যবসা শুরু করে। কিন্তু তার ডানায় তখন অন্য হাওয়া খেলছে। অচিরেই স্থানীয় দুষ্কৃতীদের ইয়ারদোস্ত বানিয়ে ফেলে সদ্য তরুণটি। পুলিশের দাবি, দুষ্কৃতীদের নিজের এলাকায় গা-ঢাকা দেওয়ার বন্দোবস্ত করত তাপস। এ ভাবেই অপরাধ জগতের চৌকাঠ পেরোয় সে।

কাঁচা টাকা আর ক্ষমতার লোভ তার বরাবরের। ২০০৮ সালে তৃণমূলে যোগ দেয় তাপস। তারপরে আর পিছনে থাকাতে হয়নি। তাপসের ‘কেরিয়ার’ এগোয় তরতরিয়ে, জানাচ্ছেন স্থানীয় মানুষজন।

পুলিশ সূত্রের খবর, ২০০৮ সালে পঞ্চায়েত ভোটের পর থেকেই দক্ষিণ ২৪ পরগনার বামদুর্গে ফাটল ধরে। ডায়মন্ড হারবারে সিটুও ক্রমে পিছু হঠতে থাকে। ২০১১ সালে রাজ্যের পালাবদলের পরে বন্দরের দখল নেয় তৃণমূল। অভিযোগ, এলাকার বিধায়ক দীপক হালদারের হাত ধরে বন্দরের কব্জা নেয় তাপস। জাহাজ থেকে মাল খালাসের বরাত হাতে আসতে থাকে। আর বাড়তে থাকে প্রভাব-প্রতিপত্তি।

বন্দরের এক তৃণমূল নেতার কথায়, ‘‘দিনে হাজার দু’য়েক শ্রমিক বন্দরে মাল খালাসের কাজ করেন। শ্রমিক-পিছু দিনে ৩৫০ টাকা মজুরি দেওয়া হয়। যার প্রায় অর্ধেকটাই তাপস আর তার সাঙ্গোপাঙ্গদের জন্য প্রণামী গুণতে হয় শ্রমিকদের।’’ সব মিলিয়ে তাপস-শিবিরের আয় দিনে নয় নয় করে প্রায় ৩ লক্ষ টাকা তো বটেই— জানাচ্ছেন তৃণমূল কর্মীদেরই একটি অংশ। তাঁদের দাবি, সব মিলিয়ে আয় দাঁড়ায় মাসে প্রায় কোটি খানেক। যার একাংশ উপরতলার নেতাদের কাছেও পৌঁছে যায়, নানা সময়ে তাপস নাকি নিজের মুখেই এ কথা জানিয়েছে তার ঘনিষ্ঠ মহলে।

এমন ‘কাজের’ ভাইকে কোলছাড়া করতে চাননি সেই দাদারাও। তাঁদেরই কারও কারও দাক্ষিণ্যে ২০১৩ সালে পঞ্চায়েত ভোটে তৃণমূলের টিকিটে লড়ে যায় তাপস। বিরোধীদের অভিযোগ, ভোটে নিজের বাহিনী নিয়ে অবাধে বুথ থেকে বুথে ছাপ্পা দিয়ে বেড়ায় সে। ভোটে জিতে পঞ্চায়েত সদস্য হওয়ার পরে আরও পোয়াবারো হয় তার।

তাপসের এ হেন রাজকীয় উত্থানের নেপথ্যে বিদায়ী বিধায়ক দীপক হালদারের ‘আশীর্বাদ’ সব সময়েই তার মাথায় ছিল বলে জানাচ্ছে দলের একটি অংশ।

কিন্তু বরাত কি আর সব সময় সঙ্গী হয়!

স্থানীয় কিছু তৃণমূল নেতা জানালেন, বছর দু’য়েক আগে থেকে বন্দরের দখল নিয়ে বিধায়কের গোষ্ঠীর সঙ্গে দলেরই আর এক গোষ্ঠীর বিবাদ শুরু হয়। মারপিটও বাধে। বিধায়ক গোষ্ঠী ক্রমে কোণঠাসা হতে থাকায় তাপসেরও বোলবোলা কিছুটা কমে। বছরখানেক আগে ফকিরচাঁদ কলেজে ছাত্রসাংসদের ভোট নিয়ে পুলিশকর্মীদের সঙ্গে বচসায় জড়িয়ে দীপক হালদার গ্রেফতার হন। দল থেকে সাসপেন্ড করা হয় তাঁকে। ওই সময়টায় তাপসও কিছুটা কোণঠাসা ছিল। তবে ভোটের আগে দীপককে দলে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। সরিষা থেকে ডায়মন্ড হারবার পর্যন্ত ভোটের প্রচারে এ বার দীপকবাবুর পাশেই দেখা গিয়েছে তাপসকে।

তবে তাপসের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতার কথা মানতে চাননি দীপকবাবু। তিনি বলেন, ‘‘তাপস দলের আমাদের কর্মী ঠিকই, কিন্তু তার সঙ্গে আমার বাড়তি কোনও ঘনিষ্ঠতা নেই।’’ কলেজছাত্র খুনের ঘটনায় অভিযুক্তদের গ্রেফতারের দাবি তুলেছেন তিনিও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন