দুষ্কৃতীরা ‘নিরাপদ’ আশ্রয়ের জন্য বেছে নিচ্ছে রামপুরহাট ও তারাপীঠ এলাকাকে। স্বাভাবিক ভাবে চিন্তিত এলাকার বাসিন্দা থেকে পুলিশ-প্রশাসন। সেই চিন্তা বাড়িয়ে দিয়েছে কলকাতায় ভোটের দিন গিরিশ পার্কে সাব ইনস্পেক্টর জগন্নাথ মণ্ডল গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা। কারণ, ওই ঘটনায় মূল অপরাধী গোপাল তিওয়ারি এখনও ফেরার হলেও গত সাত দিন আগে বীরভূমের নলহাটি থানার বারা গ্রাম থেকে তারই ঘনিষ্ঠ দুষ্কৃতী সমীর দাস ওরফে ছোট্টুকে পাকড়াও করে লালবাজারের গোয়েন্দারা। শুধু তাই নয়, ধৃত সমীরকে জিজ্ঞাসাবাদ করে গোপালের বাড়ির অস্ত্রাগার এবং সিসিটিভি’র হদিস পায় পুলিশ। গোপালের ব্যবসা দেখভালের পাশাপাশি ভোটের সময় সমীর তাকে অস্ত্র জোগাড় করেছিল বলেও তদন্তকারীদের দাবি।
তবে শুধু সমীর দাস নয়, কলকাতা এবং তার বাইরে নানারকম অপরাধমূলক কাজ করে তারাপীঠ ও রামপুরহাট এলাকায় অপরাধীরা বিভিন্ন সময়ে ডেরা নিচ্ছে। তারাপীঠকে কিছুটা হলেও ডেরা বাঁধার ক্ষেত্রে অনেকয়া সহজ বলে মনে করছে তারা। প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালের জুলাই মাসে উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বামনগাছি এলাকায় কলেজ ছাত্র সৌরভ চৌধুরী খুনের ঘটনায় মূল অভিযুক্ত শ্যামল কর্মকারকে তারাপীঠ থেকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ । পুলিশি তদন্তে জানতে পারা গিয়েছে, শ্যামল ও তার সঙ্গারা তিনদিন ধরে তারাপীঠে ডেরা নিয়েছিল এবং রামপুরহাটে ট্রেন ধরে উত্তরবঙ্গে পালিয়ে যাওয়ার ছক কষেছিল তারা। কিন্তু রামপুরহাট স্টেশনে আসতেই শ্যামল পুলিশের জালে ধরা পড়ে যায়। দুই: তারাপীঠে বেড়াতে নিয়ে আসার নাম করে বছর চারেক আগে সন্ধ্যায় দ্বারকা সেতুর কাছে কৃষ্ণনগরের এক যুবক খুন হন। ওই ঘটনাতেও তারাপীঠ থেকে রামপুরহাট স্টেশনে ট্রেন ধরে পালানোর আগে ঘটনায় সঙ্গে যুক্ত বরাহনগরের এক সুপারি কিলার-সহ এক যুবতী ধরা পড়ে। তিন: তারাপীঠেই বছর পাঁচেক আগে লজের ভিতরে এক গৃহবধূর গলা কাটা দেহ উদ্ধার হয়। আবার বছর খানেকের ব্যবধানে তারাপীঠে দ্বারকা নদের ধারে দুই মহিলার ক্ষতবিক্ষত দেহ উদ্ধার হয়। দু’টি ঘটনার কিনারা এখনও পুলিশ করতে পারেনি। শুধু তাই নয়, ২০১৪ সালের ২৭ জুলাই তারাপীঠেই দু’জন মহিলার শ্লীলতাহানির দায়ে দীপকুমার শাস্ত্রী নামে এক জ্যোতিষি ধরা পড়ে। আবার নকল সরকারি অফিসার সেজে যাবতীয় সরকারি সুযোগ সুবিধা নেওয়ার জন্য তারাপীঠ থেকে ২০১৪ সালের ৩০ অগস্ট সল্টলেকের এক ব্যক্তি ধরা পড়ে। একই রকম ভাবে তারাপীঠ এলাকায় জাল নোটের কারবার চালাতে গিয়ে গত বছর মুর্শিদাবাদ জেলার একজন জালনোটের কারবারি ধরা পড়ে। আবার তারাপীঠ এলাকায় গত বছর ধানবাদের একজন বিখ্যাত গাড়ি চোরাই এর কারবারী ধরা পড়লেও পুলিশি নিষ্কৃয়তার তারাপীঠ পুলিশ ফাঁড়ি থেকে ওই অপরাধী পালিয়ে যায়।
স্বাভাবিক ভাবে প্রশ্ন উঠেছে, শুধু জেলা নয়, জেলার বাইরে অপরাধমূলক কাজকর্ম করে এসে তারাপীঠ ও রামপুরহাট এলাকায় দুষ্কৃতীরা নিরাপদে আশ্রয় নিচ্ছে কেন? পুলিশ-প্রশাসন তাদের রুখতে পারছে নাই বা কেন? জেলা পুলিশের এক কর্তা বলেন, ‘‘তারাপীঠে প্রতিনিয়ত বাইরে থেকে নিত্যনতুন লোকের আনাগোনা লেগেই থাকে। হাজার হাজার লোকের ভীড়ে সহজে অপরাধ করে মিশে যেতে সহজ হয় অপরাধীদের। এ ছাড়া তারাপীঠে বেশ কিছুদিন আগে পর্যন্ত লজ ব্যবসায়ীদের একাংশ সঠিক পরিচয়পত্র না দেখে লোকজনকে থাকতে দিত। সেটা অবশ্য এখন প্রশাসনিক চাপে বন্ধ হয়ে গেলেও এখনও কিছু লজ মালিক আড়ালে কোনও প্রমাণপত্র ছাড়াই ঘর ভাড়া দিচ্ছেন। আবার তারাপীঠ এলাকায় লজ ব্যবসায়ীদের একাংশ এখনও প্রত্যেক বোর্ডারদের সচিত্র পরিচয়পত্র বা প্রমাণপত্র না দেখে ঘর ভাড়া দিচ্ছেন। ঠিক এ ভাবেই কিন্তু শ্যামল কর্মকার অন্য একজনের সঙ্গী হিসেবে অন্যের জমা দেওয়া পরিচয়পত্র দিয়ে তিন জন লজ ভাড়া করেছিল। এর পর থেকে প্রশাসন এবং তারাপীঠ লজ ব্যবসায়ীরা কিছুটা তৎপরতা দেখালেও তারাপীঠ ঘুরে কেউ যদি এখনও মনে করে বিনা প্রমাণপ্রত্র ছাড়া লজ ভাড়া নেব, তা হলে কিন্তু খুব সহজে লজ পাওয়া যায়।’’ এই নিয়ে রামপুরহাট মহকুমাশাসক উমাশঙ্কর এস বলেন, ‘‘তারাপীঠে যাতে সচিত্র পরিচয়পত্র দেখিয়ে লজ ভাড়া দেওয়া হয় তার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশ লজ ব্যবসায়ীদের দেওয়া হয়েছে এবং পুলিশের কাছে প্রতিদিনের ভাড়াটিয়াদের তালিকা জমা দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই সমস্ত নির্দেশ যদি কেউ না মেনে চলছে, তাদের ক্ষেত্রে প্রশাসন আইনানুগ ব্যবস্থা নিয়েছে।’’
এত যদি ব্যবস্থা নেওয়া হয়, তা হলে এ সব ঠেকানো যাচ্ছে না কেন? প্রসঙ্গত, সমীর দাসের বাড়ি নলহাটি থানার বুজুং গ্রামে। নলহাটি থানার বারা গ্রামে সমীর দাসের মামার বাড়ি। বারা গ্রাম থেকে অনেকে কলকাতার বিভিন্ন এলাকায় পরিচারিকার কাজ করে। সমীর সেই সূত্রে মামার বাড়ির আত্মীয় স্বজনের মাধ্যমে কলকাতায় বেশ কয়েকবছর আগে থাকে। জেলা পুলিশের এক কর্তা বলেন, ‘‘তারাপীঠে দিনের পর দিন শ্রীবৃদ্ধি ঘটছে। তারাপীঠকে পুরসভা করা হচ্ছে। এ ছাড়া আলাদা করে তারাপীঠ-রামপুরহাট উন্নয়ন পর্ষদ গঠিত হয়েছে। এত কিছুর মাঝে তারাপীঠকে আলাদা থানা করা উচিত। তা হলে বর্তমানের তারাপীঠ ফাঁড়ির যে পরিকাঠামো সেই পরিকাঠামো থানা হয়ে গেলে আরও উন্নত হবে।’’
পুলিশ কর্তাদের দাবি, যে তুলনায় কাজের চাপ বেড়েছে সেই তুলনায় পুলিশ কর্মীর সংখ্যাও নেই। আবার ময়ূরেশ্বর, নলহাটি থানাকে ভেঙে আরও দু’টি পৃথক থানা করা উচিত বলে অনেক পুলিশ কর্মীদের অভিমত।