নিহত আরপিএফ কর্মী সমরেশ সামন্তের দেহের সামনে তাঁর বাবা অরুণবাবু।
জৈষ্ঠের রোদের তেজ তখন খানিক পড়েছে। বিকেল চারটে নাগাদ ধরাধরি করে নিয়ে আসা হচ্ছিল এক বৃদ্ধকে। একটি চেয়ারে এসে বসলেন তিনি। নীরব, নিষ্পলক।
তিনি অরুণ সামন্ত। তাঁর শূন্য দৃষ্টি যে সাদা চাদরটার দিকে, তার তলাতেই রয়েছে তাঁর মেজো ছেলে সমরেশের দেহ। যে দেহে দু’দিন আগেও ছিল ভীষণ প্রাণ। এখন তা নিথর। তাকিয়ে থেকে যেন বাস্তবটা বিশ্বাস হচ্ছিল না বৃদ্ধের। নিজে নিজে বলে যাচ্ছিলেন, ‘‘ছেলেটা কাজে কখনও ফাঁকি দিত না। অহেতুক ছুটি নিয়ে বাড়িতে গিয়ে বসে থাকে না। ওকেই কি না গুলি খেয়ে মরতে হল!’’
চেপে রাখা কান্নাটা বাধ মানল না অন্য এক কান্নার শব্দ শুনেই। ইংরেজবাজারের মহানন্দাপল্লিতে আরপিএফের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে এসে পৌঁছল একটি ম্যাক্সিট্যাক্সি। ৫০ মিটার দূর থেকেই শোনা যাচ্ছিল কান্নার শব্দ। তা শুনতে পেয়েই কান্না চেপে রাখতে পারলেন না অরুণবাবু। চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করে দেন তিনি। গাড়ি থামতে এক এক করে মৃত সমরেশের আত্মীয় পরিজনেরা চোখের জল মুছতে মুছতে নেমে পড়েন। মৃত স্বামীর দেহ দূর থেকে জাতীয় পতাকায় ঢাকা দেখেই কান্নায় লুটিয়ে পড়েন স্ত্রী পম্পা সামন্ত। তিন-চারজন তাঁকে কোনও রকমে ধরে মৃতদেহের ডান দিকে বসান। সেই সময় চারদিকে শুধু কান্নার রোল। পরিজনের পাশাপাশি ভিড় করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারাও। তাঁদের চোখেও জল। অরুণবাবুর তিন ছেলে। বড় ছেলে অমরেন্দ্র সিআইএসএফের চাকরি করেন। সমরেশ ছিলেন মেজো। আর ছোট ছেলে জ্যোতি বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করেন। সকলেই তাঁরাও কান্নায় ভেঙে পড়েন।
নিহত আরপিএফ কর্মী সমরেশ সামন্তের দেহের সামনে তাঁর স্ত্রী পম্পাদেবী।
এ দিন সকাল থেকেই এলাকার পরিবেশ ছিল নিস্তব্ধ। বেলা সাড়ে তিনটে মালদহ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের মর্গ থেকে ওই কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয় সমরেশবাবুর দেহ। দেহ নিয়ে গিয়ে রাখা হয় প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের মাঠের মধ্যে। নিথর সহকর্মীর দেহ ঘিরে ভিড় করে থাকেন অন্য জওয়ানেরা। ঘটনাস্থলে আসেন আরপিএফের মালদহের কমান্ড্যান্ট এস. এস.তিওয়ারি। তিনি সকলকে লাইন করে দাঁড়ানোর নির্দেশ দেন। এরপর বিকেল চারটে নাগাদ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে পৌঁছন নিহতের বাবা অরুণবাবু। পরে পরিবারের বাকিরা।
বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ আসেন পূর্ব রেলের মালদহ ডিভিশনের ডিআরএম রাজেশ আরগাল-সহ আরপিএফের একাধিক উচ্চপদস্থ কর্তারা। এরপরে নিহত সমরেশবাবুকে দেওয়া হয় গার্ড অফ অনার। তখন পেশাদারি কাঠিন্য ভেঙে কান্নায় চোখ ভিজে আসছিল একাধিক আরপিএফ জওয়ানের। এক এক করে পরিবার পরিজনেরা থেকে শুরু করে আরপিএফ জওয়ানেরা ফুল দিয়ে শেষ শ্রদ্ধা জানান। ইংরেজবাজারের সাদুল্লাপুরে শেষকৃত্য সম্পন্ন হয় সমরেশবাবুর। ডিআরএম রাজেশ আরগাল বলেন, ‘‘বাড়ির লোকেদের সান্ত্বনা দেওয়ার মতো ভাষা নেই আমাদের কাছে। ওই জওয়ানের পরিবারকে রেলের তরফ থেকে যাবতীয় সুবিধে দেওয়ার চেষ্টা করব।’’
সোমবার বিকেলের পর থেকেই মালদহ টাউন স্টেশন চত্বর সুনসান চেহারা নেয়। রিকশা, অটো তেমন চোখে পড়েনি। ট্যাক্সি স্ট্যান্ড ফাঁকা পড়ে ছিল। টিকিট কাউন্টারের সামনে বসানো হয়েছে রেল পুলিশ পিকেট। এ দিন হকারদের স্টেশন চত্বরে দেখা যায় নি। থমথমে ছিল স্টেশন চত্বর।
মঙ্গলবার মনোজ মুখোপাধ্যায়ের তোলা ছবি।