মনখারাপের বইঘর: পর্ব-২

উত্তরবঙ্গ জুড়ে রয়েছে ঐতিহ্যবাহী বহু সাধারণ গ্রন্থাগার। কোচবিহার শহরেই রয়েছে ‘রাষ্ট্রীয়’ তকমাধারী লাইব্রেরি। কিন্তু বাস্তব ছবি এটাই যে, পরিকাঠামো, কর্মী আর সংরক্ষণের অভাবে ধুঁকছে প্রায় সব গ্রন্থাগারই। একই সঙ্গে কমে গিয়েছে পাঠকের বই পড়ার অভ্যাসও। লিখছেন অরিন্দম সাহাকোচবিহার শহরের সাগরদিঘি চত্বর লাগোয়া এলাকায় তৈরি সেই উত্তরবঙ্গ রাষ্ট্রীয় গ্রন্থাগারের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে রাজকীয় ঐতিহ্যের ইতিহাস। তারপরও সেখানে সমস্যার সাতকাহনের অভিযোগ রয়েইছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৬ মার্চ ২০১৯ ০৫:৩১
Share:

৩০০ বছরের পুরনো বই। —ফাইল চিত্র।

নামেই ‘রাষ্ট্রীয়’ গ্রন্থাগার। মর্যাদা অবশ্য ‘জেলা’ গ্রন্থাগারের। কোচবিহার শহরের সাগরদিঘি চত্বর লাগোয়া এলাকায় তৈরি সেই উত্তরবঙ্গ রাষ্ট্রীয় গ্রন্থাগারের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে রাজকীয় ঐতিহ্যের ইতিহাস। তারপরও সেখানে সমস্যার সাতকাহনের অভিযোগ রয়েইছে।

Advertisement

অপর্যাপ্ত কর্মীসংখ্যা, বড় ঘরের অভাব, রাজ-আমলের পুঁথি এবং নথিপত্র ডিজিটাইলেশন করার কাজ হয়নি। শিকেয় উঠেছে প্রত্যন্ত জেলার ওই গ্রন্থাগার থেকে এলাকার গ্রন্থাগারগুলিতে ভ্রাম্যমাণ পুস্তক পরিষেবার কাজও। বই সংরক্ষণের পরিকাঠামোর নানা সমস্যাও রয়েছে। কোচবিহার জেলার এক নম্বর গ্রন্থাগারের এমন সমস্যা অবশ্য একেবারে নতুনও নয়। তার মধ্যেও এই গ্রন্থাগার হয়ে উঠছে চাকরির পরীক্ষার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। জেলার প্রত্যন্ত এলাকা থেকে আগ্রহী তরুণ-তরুণীরা সেখানে নিয়মিত ক্লাস করতেও আসছেন। নিখরচার ওই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে সরকারি চাকরির পরীক্ষার প্রাথমিক পর্বে বেশ কয়েকজন উত্তীর্ণও হয়েছেন।

তাতেও অবশ্য নামের সঙ্গে মিল রেখে বাস্তবে ‘রাষ্ট্রীয়’ স্বীকৃতি না মেলার আক্ষেপ ঘোচেনি। এ নিয়ে চিঠিচাপাটি, আলোচনা, আর্জি নানা সময়ে বিভিন্ন মহল থেকে করা হয়েছে। কিন্তু কাজ হয়নি। তাই কাঙ্ক্ষিত ‘এ’ ক্যাটাগরিতে উন্নীত হতে পারেনি গ্রন্থাগারটি। ‘বি’ ক্যাটাগরির তালিকাভুক্ত হলেও বার্ষিক আর্থিক বরাদ্দ বাড়বে, ‘আপগ্রেডেশন’ হলে বাড়বে কর্মীসংখ্যাও। উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী রবীন্দ্রনাথ ঘোষ এ বিষয়ে বলেন, “গ্রন্থাগারের আপগ্রেডেশন নিয়ে গ্রন্থাগার মন্ত্রীর সঙ্গে নিয়ে কথা বলেছি।”

Advertisement

সংশ্লিষ্ট দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, ১৯৬৯ সালে প্রায় পৌনে তিন বিঘা জমির উপর এই গ্রন্থাগার তৈরি হয়। ১৮৭০ সালে প্রতিষ্ঠিত কোচবিহার স্টেট লাইব্রেরি এবং ১৯৫৭ সালে প্রতিষ্ঠিত কোচবিহার জেলা গ্রন্থাগারকে এক সঙ্গে মিলিয়ে আত্মপ্রকাশ করে উত্তরবঙ্গ রাষ্ট্রীয় গ্রন্থাগার। যেখানে রয়েছে লক্ষাধিক বইয়ের সম্ভার। কোচবিহারের মহারাজাদের লেখা প্রাচীন পুঁথি থেকে সোনার প্রলেপে মোড়ানো প্রাচীন বাইবেলের মতো অসংখ্য বই এই গ্রন্থাগারের বড় সম্পদ। রয়েছে নারায়ণ দেবের পদ্মপুরাণ, কাঠের ফলকে হাতে আঁকা ছবি-সহ রামায়ণ, মহাভারত। রয়েছে মিশরীয় সভ্যতার হাতে আঁকা ছবি, আয়ারল্যান্ড থেকে প্রকাশিত ব্রজসূচি। যার অনেকগুলি লাল শালুতে, তুলোট কাগজে মুড়ে রাখা হয়েছে।

গ্রন্থাগারের এক কর্মীর কথায়, ‘‘এত দুষ্প্রাপ্য এবং প্রাচীন পুঁথি আর নথি খুব কম গ্রন্থাগারেই রয়েছে। তারপরও এতদিনেও গ্রন্থাগারটিকে রাষ্ট্রীয় গ্রন্থাগারে উন্নীত করা হয়নি!’’

কেন ‘রাষ্ট্রীয়’ তকমা বাস্তবে মিলছে না? এক আধিকারিকের বক্তব্য, ‘‘আপগ্রেডেশন কিছু নির্দিষ্ট বিষয়ের উপরও অনেকাংশে নির্ভর করে। কিন্তু এই গ্রন্থাগারে লাইব্রেরি অ্যাসিস্ট্যান্ট, দারোয়ান, পিওন, সাফাইকর্মী, ড্রাইভার-সহ অন্তত ছ’টি পদ ফাঁকা পড়ে রয়েছে। বড় একটি ভবন তৈরির উদ্যোগ অনেকদিন আগে নেওয়া হলেও সে কাজ হয়নি। দ্রুত এইসব সমস্যা মেটানো দরকার। প্রাচীন পুঁথি, নথি এবং বইপত্র ডিজিটালাইজেশন করায় উদ্যোগী হওয়াও খুব জরুরি।’’

কোচবিহারের উত্তরবঙ্গ রাষ্ট্রীয় গ্রন্থাগারের মতো কম-বেশি প্রায় একই সমস্যা জেলার একাধিক টাউন ও গ্রামীণ গ্রন্থাগারেরও। গ্রন্থাগার দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, কোচবিহার জেলায় সাতটি টাউন গ্রন্থাগার রয়েছে, গ্রামীণ গ্রন্থাগারের সংখ্যা ১০২। গ্রামীণ গ্রন্থাগারে গ্রন্থাগারিক-সহ অন্তত দু’জন করে কর্মী থাকার কথা। কিন্তু বহু গ্রন্থাগারেই তা নেই। কিছু গ্রন্থাগারে পরিষেবা প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কিছু গ্রন্থাগারে পালা করে অন্য কর্মীদের এনে সপ্তাহে একদিন কিংবা দু’দিন খোলা হচ্ছে।

মোটের উপর সাধারণ পাঠকেরা পরিষেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। কবে ওই সব স্থায়ী শূন্যপদ পূরণ হবে, সে ব্যাপারে প্রশাসন বা দফতরের কর্তাদের কেউই স্পষ্ট করে কিছু জানাতে পারছেন না। ডিস্ট্রিক্ট লোকাল লাইব্রেরি অথরিটির চেয়ারম্যান তথা কোচবিহারের জেলাশাসক কৌশিক সাহা বলেন, ‘‘জেলার গ্রন্থাগারে শূন্যপদের সমস্যা রয়েছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে শূন্যপদ পূরণের ব্যাপারে আর্জি জানানো হয়েছে।” কোচবিহার জেলা গ্রন্থাগারিক শিবনাথ দে বলেন, “বর্তমানে গ্রন্থাগারের যেটুকু পরিকাঠামো রয়েছে, তারই মধ্যে যতটা করা সম্ভব, সব রকম ভাবে তা করার চেষ্টা করা হচ্ছে।”

কিন্তু তাতে কি কোনও লাভ হচ্ছে? বইপ্রেমীদের একাংশের বক্তব্য, কর্মী না থাকায় বেশ কিছু গ্রন্থাগারে তালা পড়েও গিয়েছে। তার উপর অপেক্ষাকৃত ছোট ঘর, ছাদ বা টিনের চাল দিয়ে জল পড়ার মতো সমস্যাও রয়েছে। বাস্তবে আগ্রহী পাঠকদের খেসারতই দিতে হচ্ছে। গ্রন্থাগার দফতরের এক কর্তার দাবি, উত্তরবঙ্গ রাষ্ট্রীয় গ্রন্থাগারে এজেন্সির মাধ্যমে চুক্তিভভিত্তিক কর্মী নিয়োগের ব্যাপারেও চেষ্টা হচ্ছে। তাতে চটজলদি সমস্যা মেটার একটা আশা রয়েছে। স্থায়ী অনুমোদিত পদগুলি পূরণের উদ্যোগও রয়েছে।

গ্রন্থাগার কর্তারা জানাচ্ছেন, সমস্যার মধ্যেও গল্প, উপন্যাস, কবিতা, ভ্রমণকাহিনির পাশাপাশি এখন গ্রন্থাগারে চাকরির পরীক্ষার উপযোগী বইপত্রের সম্ভার বাড়ানোর উপরও জোর দেওয়া হচ্ছে। তাতে কোচবিহারের ওই রাষ্ট্রীয় গ্রন্থাগার ইতিমধ্যে সাড়া ফেলেছে। সেখানে নিখরচায় প্রতিযোগিতামূলক চাকরির বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। জেলা প্রশাসনের পদস্থ কর্তারা সেখানে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। কিছুদিন আগে দুই আইএএস এবং আইপিএস নিয়মিত ক্লাস নিয়েছেন। তাঁরা বদলি হয়ে যাওয়ার পর সম্প্রতি এক আইপিএস ক্লাস নিয়েছেন। গত এক বছরে ওই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ১০ জন ডব্লুবিসিসি (প্রিলি) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। একাধিক চাকরিও হয়েছে। ফলে, ওই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নিয়ে উৎসাহ ক্রমশ বাড়ছে। উত্তরবঙ্গ রাষ্ট্রীয় গ্রন্থাগারের আধিকারিক শিশির সরকার বলেন, “আমাদের গ্রন্থাগারে শতাধিক তরুণ-তরুণী ক্লাস করেন।”

বাসিন্দাদের অনেকের বক্তব্য, এই উদাহরণ ব্যতিক্রমী ঘটনা মাত্র। জেলাজুড়ে অন্য গ্রন্থাগারে সে রকম ব্যবস্থা নেই। এমনকি, খাতায়-কলমে যত সদস্য রয়েছেন, তাঁদের বড় অংশ বেশির ভাগ গ্রন্থাগারে নিয়মিত যাতায়াতও করেন না, বই লেনদেন তো দূরঅস্ত্‌। কোচবিহারের ওই রাষ্ট্রীয় গ্রন্থাগারের কথাই ধরা যাক। কর্তৃপক্ষের দাবি, তাঁদের সদস্য সংখ্যা ১৬ হাজারের বেশি। রয়েছে শিশু বিভাগ, ব্রেল বিভাগ, সাধারণ পাঠকক্ষের মতো একাধিক বিভাগ। অভিযোগ, সেখানেও গড়ে দৈনিক ১৩৫-১৪০ জনের বেশি সদস্য আসেন না।

গ্রামীণ গ্রন্থাগারগুলির সার্বিক ছবিটা মোটের উপর আরও খারাপ। তাই বই পড়া নিয়ে আগ্রহ বাড়ানোর ব্যাপারেও পরিকল্পনা করে এগনোর কথা ভাবার সময় এসেছে। শুধুমাত্র পরিকাঠামোর সমস্যাকে অবশ্য এর জন্য কাঠগড়ায় তুলতে রাজি নন গ্রন্থাগার কর্মীদের অনেকেই। এক গ্রন্থাগারিকের কথায়, ‘‘আমাদের গ্রন্থাগারে নিয়মিত যাঁরা বই লেনদেন করতেন, তাঁদের মধ্যে কয়েকজন বেশ কিছু দিন ধরেই অনিয়মিত। তাঁদের একজনের কাছে অনিয়মিত উপস্থিতির কারণ বিষয়ে জানতে চেয়েছিলাম। তাতে যা উত্তর পেয়েছি, সেটাও ভাবার! তিনি জানিয়েছেন, কাজকর্মের পরে এখন মোবাইলে ফেসবুক করছেন।’’ এ বিষয়ে প্রাবন্ধিক দেবব্রত চাকি বলেন, “সামাজিক মাধ্যমের কিছুটা ভূমিকা হয়তো রয়েছে এ ক্ষেত্রে। তবে, সেটাই একমাত্র কারণ নয়। অনেক ক্ষেত্রে পছন্দের বই থাকে না। গ্রন্থাগারে রেফারেন্স বইয়ের চাহিদা বেশ খানিকটা বেড়েছে। অবশ্য সেটা সব জায়গায় নেই।”

অভিযোগ আরও রয়েছে। তার মধ্যে সর্বত্র শিশুদের জন্য নির্দিষ্ট বিভাগ না থাকা, ইন্টারনেট সুবিধে না থাকা, বসার সুবন্দোবস্ত না থাকার মতো বিষয়গুলিও রয়েছে। শিক্ষিকা দেবলীনা বিশ্বাস বলেন, “আমি এক সময় নিয়মিত গ্রন্থাগারে যেতাম। কিন্তু এখন ট্যাবে অনলাইনই বেশি পড়ছি। তাই কিছুটা যাতায়াত কমেছে। তবে, গ্রন্থাগারের বই এনে পড়ার মজাটা সব সময়ই আলাদা!’’ বইপ্রেমীদের অনেকেরই অভিমত, সেই মজাটাই ধরে রাখা দরকার। এর জন্য গ্রন্থাগারগুলির পরিকাঠামো উন্নয়ন থেকে বরাদ্দ বৃদ্ধি যেমন দরকার, তেমনই পাঠকের পছন্দের বইয়ের সম্ভারও বাড়াতে হবে। নিছক বই কেনার জন্য কেনা হলে, তাতে খুব একটা লাভ হবে না।

কোচবিহারের এক বাসিন্দা সন্তোষ দে সরকার নিজে ‘ভ্রাম্যমাণ গ্রন্থাগার’ নিয়ে পাঠকের বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ান। তাঁর কাছ থেকে এলাকার অনেক বাসিন্দাই নিয়মিত বই নেন, বই পড়েন। কোচবিহার উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা নবনীতা সিকদারের কথায়, ‘‘বই পড়ার সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে এই রকম উৎসাহীদেরও দরকার। এখন নানা কারণে মানুষের জীবনে ব্যস্ততা বেড়েছে। তাই ইচ্ছে থাকলেও অনেকের পক্ষে গ্রন্থাগারে গিয়ে বইপত্র পড়ার বা গ্রন্থাগার থেকে বাড়িতে বইপত্র নিয়ে এসে পড়ার সময় হয় না। বাড়িতে বই পৌছে দেওয়ার এমন ব্যবস্থা থাকলে বা বৃদ্ধি পেলে পড়ার আগ্রহ নয়া মাত্রা পাবে।” বইপ্রেমীদের একাংশের বক্তব্য, যেখানে কর্মীসংখ্যার অভাবে বহু গ্রন্থাগার ধুঁকছে, সেখানে এমন আশা করাটা কঠিনই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন