রেলের চতুর্থ শ্রেণির কর্মী থেকে শিলিগুড়ির মহানন্দা নদীর একপাশের বিরাট এলাকার ‘বেতাজ বাদশা’-জয়প্রকাশ চৌহান ওরফে হিম্মতের উত্থানটা অনেকটাই চোখ ধাঁধানো। গত ৩৫ বছরে বাম, ডান শিবির একাধিকবার বদলালেও ক্ষমতাসীন শাসকের ছাতার তলায় থেকেই হিম্মত নিজের সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন বলে জানাচ্ছে পুলিশই। তদন্তকারী পুলিশ অফিসারেরা বলছেন, জংশন স্টেশন, কুলিপাড়ায় হাতে গোনা যুবকদের নিয়ে দল গড়ে পরিচিত হয়েছিলেন হিম্মত। তারপর সেই আমলে শহরের তথাকথিত ‘দাদা’দের তালিকায় নাম তুলতে বেশিদিন সময় লাগেনি। নানা সমস্যায় বস্তি থেকে কলোনিবাসীর পাশে দাঁড়ানো, সঙ্গে দাদাগিরি করে ভালই চলছিল হিম্মতের।
বাবা শিবপ্রসাদ চৌহান রেলকর্মী ছিলেন। চম্পাসারির কংগ্রেস নেতা হিসাবে পরিচিত শিবপ্রসাদবাবু ১৯৮৩ সালে খুন হন। কংগ্রেসের অভিযোগ ছিল, সিপিএমের দিকে। যদিও বামেদের দাবি, স্থানীয় গোলমালে খুন হয়েছিলেন হিম্মতের বাবা। পুলিশ সূত্রের খবর, বাবা মারা হওয়ার পর হিম্মতের মা রেলের চাকরিতে যোগ দেন।
সেই সময় হঠাৎ রাতারাতি চম্পসারিতে সিপিএমের সক্রিয় কর্মী হিসাবে ময়দানে নেমে পড়েন হিম্মত। দলের চম্পাসারি, প্রধাননগরের দু’জন নেতার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেন তিনি। সিপিএম আমলে শুরু হয় তার কাঠের ব্যবসা। তার পরে বালিপাথর, পরিবহণ ব্যবসা। ধীরে ধীরে হাত পাকাতে থাকেন জমির কারবারেও। সেবক রোডের একটি অফিসে বসে কারবার চালাতেন ধৃত তৃণমূল নেতা।
কমিশনারেটের পুলিশ অফিসারেরা জানান, একসময় অনটনের পরিবার ছিল হিম্মতের। মায়ের বদলি হিসাবে হিম্মত রেলে চাকরিও করেন। কিন্তু বাম নেতাদের ‘আশ্রয়ে’ ব্যবসা ফুলেফেঁপে ওঠায় এক সময় চাকরি ছেড়ে দেন। তার পরে ধাপেধাপে জমি, পরিবহণ ব্যবসায় নেমে পড়েন। টাকার স্রোত বাড়তে থাকায় লোকবলও বাড়ে হিম্মতের। এক সময় বামেদের একাংশের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব বাড়তে থাকে। এরপর হিম্মত ঢুকে পড়েন আবার বাবার পুরানো দল কংগ্রেসে।
সিপিএম নেতা তথা শহরের মহানাগরিক অশোক ভট্টাচার্য বলছেন, ‘‘এ সব চৌহানদের তো ঘাসফুলের আমলেই বাড়বাড়ন্ত। মুখ্যমন্ত্রী ভাল উদ্যোগ নিয়েছেন। কিন্তু জমি কারবারে জনপ্রতিনিধি থেকে যাঁরা যাঁরা জড়িত, তাঁদের সব চিহ্নিত করার জন্য উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত প্রয়োজন।’’
পুলিশ সূত্রের খবর, ধীরে ধীরে এগোতে থাকেন হিম্মত। কয়েক কোটি টাকার সম্পত্তির মালিক হন। বাড়তে থাকে জমির কারবার। কিন্তু শাসকের ছায়ায় হিম্মত আসেন ২০১৩ সালে। রাজ্যের এক মন্ত্রীর হাত ধরে ঢুকে পড়েন ঘাসফুল শিবিরে।
এখন শিলিগুড়ি শহরেই তার তিনটে ফ্ল্যাট রয়েছে। এ ছাড়াও চম্পাসারিতে নিজের বিরাট বাড়ি তো আছেই। জেলার এক তৃণমূল নেতা ঘনিষ্ঠ অনুগামীর সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে কয়েক কোটি টাকায় শালুগাডায় হোটেল কেনেন। চম্পাসারিতে মদের দোকান, হার্ডওয়ার, মার্বেলের ব্যবসা শুরু করেন। গত এক বছর ধরে সরকারি, বেসরকারি একাধিক জমি দখলের অভিযোগ উঠছিল তার বিরুদ্ধে।
জেলা কংগ্রেস সভাপতি তথা বিধায়ক শঙ্কর মালাকার বলেন, ‘‘হিম্মত তো চুনোপুটি। আমাদের দলে কিছু দিন ছিল মাত্র। ওঁর সঙ্গে থাকা এবং পিছনে বড় মাথার লোকদের কি ধরা হবে? শিলিগুড়িবাসী সেটাই জানতে চায়।’’
তৃণমূলের বহু নেতাই অবশ্য হিম্মতকে নেতা বলতে নারাজ। তাঁরা জানান, ও তো বরাবার ম্যাসলম্যান। টাকার জোরে পুরসভা ভোটে লড়াই করেছিল। মানুষ ওকে মেনে নেয়নি। তবে আমাদের তিন-চার জন নেতা বরাবর ওকে প্রশয় দিয়েছে। তাতেই ওঁর বাড়বাড়ন্ত। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশের পর সবাই ওর পাশ থেকে সরে যাচ্ছিল।
জেলা তৃণমূল সভাপতি তথা মন্ত্রী গৌতম দেব বলেন, ‘‘এটা পুলিশ-প্রশাসনের বিষয়। আইন আইনের পথে চলবে।’’