বরফ পড়েছে হিমাচলে। অথচ এ রাজ্যে শীতের দেখা নেই। শীত-শীত ভাবটুকুই সার।
ভরা পৌষে মহানগর-সহ গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের থেকে অন্তত দু’ডিগ্রি নীচে থাকাটাই দস্তুর। বড়দিন হোক বা ইংরেজি নববর্ষ, কনকনে ঠান্ডা ছাড়া যেন কোনওটাই ঠিক জমে না। কিন্তু এ বার বড়দিন গিয়েছে কিছুটা ভ্যাপসা গরমে। ইংরেজি নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর সময়েও যে ঠকঠকিয়ে শীতে কাঁপার সুযোগ মিলবে, তেমন কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না বলেই জানাচ্ছে আবহাওয়া দফতর।
ডিসেম্বরের শেষ পর্বে, মঙ্গলবার কলকাতার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা উঠে যায় ১৭.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। এই সময়ের স্বাভাবিকের থেকে যা চার ডিগ্রি বেশি। এ দিন সকালে কুয়াশা কেটে সূর্য উঠতেই সামান্য উত্তুরে হাওয়া বইতে শুরু করেছে বটে, কিন্তু তার স্থায়িত্ব নিয়ে রীতিমতো ধন্দে আবহবিজ্ঞানীরা। ‘‘উত্তুরে হাওয়ার প্রভাবে তাপমাত্রা সামান্য নামতে পারে। তবে ওই পর্যন্তই। প্রকৃত শীত যাকে বলে, এখনই তার দেখা পাওয়ার সম্ভাবনা বিশেষ নেই,’’ বলে দিয়েছেন আলিপুর আবহাওয়া দফতরের অধিকর্তা গণেশকুমার দাস।
শীতের এই ছন্নছাড়া দশা কেন?
দিল্লির মৌসম ভবনের বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, উত্তুরে হাওয়ার ঘাটতিই এ বার শীতকে দুর্বল করে দিচ্ছে। তার উপরে বঙ্গোপসাগর থেকে ঢুকে প়ড়ছে গরম, জোলো হাওয়া। ফলে বাতাসে আর্দ্রতার সঙ্গে বাড়ছে ভ্যাপসা ভাবও। তাপমাত্রার খামখেয়ালিপনায় বাড়ছে নানা ধরনের পরজীবী-বাহিত রোগও। এ বার ডিসেম্বরের গোড়ায় জোড়া ঘূর্ণিঝড় ‘নাডা’ এবং ‘ভারদা’র ধাক্কায় শীতের দফারফা হয়ে গিয়েছিল। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সেই সব কুপ্রভাব কেটে যায়। বইতে শুরু করেছিল উত্তুরে হাওয়া। তার প্রভাবে শীত থিতু হওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছিল। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই উত্তুরে হাওয়া দুর্বল হয়ে যাওয়ায় তাপমাত্রা ফের বাড়তে শুরু করে। পারদের সেই ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা এখনও বহাল।
এ দিন যে-উত্তুরে হাওয়া বইতে শুরু করেছে, তার কারণ কী? তাতে শীতের ভবিষ্যৎই বা কতটা উজ্জ্বল?
হাওয়া অফিসের জবাবে হতাশার সুর। তারা জানাচ্ছে, সম্প্রতি একটি পশ্চিমি ঝঞ্ঝা (ভূমধ্যসাগরীয় এলাকা থেকে বয়ে আসা শীতল ও ভারী বায়ুপ্রবাহ) এ দেশে ঢুকেছে। তার দাপটে বরফ পড়ছে শিমলা, কাশ্মীরে। তাই কিছুটা উত্তুরে হাওয়া বয়ে আসছে বাংলাতেও। কিন্তু স্বস্তি বলতে ওইটুকুই। উত্তুরে হাওয়ার তীব্রতা বাড়াতে যে-সব প্রাকৃতিক প্রবণতা দরকার, সেগুলোর দেখা নেই। তাই বর্ষশেষের পাওনা বলতে শুধু শীত-শীত ভাব। শীতের দেখা মিলবে না।
অথচ গত বছরেও ২৭ ডিসেম্বর এবং তার আগে-পরে কলকাতায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল স্বাভাবিক বা তার থেকে কিছুটা নীচে। তা হলে এ বার এমন বিপত্তি কেন?
আবহবিদেরা জানাচ্ছেন, কাশ্মীরে বরফ পড়লে বাংলায় শীতের দাপট বাড়ে। কিন্তু এ বার পশ্চিমি ঝঞ্ঝার চরিত্রে কিছুটা বদল দেখা যাচ্ছে। তাই হিমালয়ে জোরালো তুষারপাত হচ্ছে না। তবে বিরল ঘটনা হিসেবে সাহারা মরুভূমিতে বরফ পড়েছে। কেন্দ্রীয় আবহাওয়া বিভাগের অতিরিক্ত ডিরেক্টর জেনারেল বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায়ের ব্যাখ্যা, ভূমধ্যসাগরের উপর দিয়ে ঝঞ্ঝা পূর্ব দিকে বয়ে আসে। সেই ঝঞ্ঝা দক্ষিণ দিকে সরে যাওয়ার ফলেই আফ্রিকার সাহারা মরুভূমিতে তুষারপাত ঘটেছে। ‘‘তবে সাহারায় তুষারপাতের সঙ্গে ভারতের শীতের সরাসরি কোনও সম্পর্ক নেই,’’ বলছেন বিশ্বজিৎবাবু। প্রায় চার দশক পরে এমন তুষারপাত হল সাহারায়। কেন এমনটা ঘটল, তা নিয়ে গবেষণাও শুরু হয়ে গিয়েছে।
পশ্চিমি ঝঞ্ঝার চরিত্র-বদল, সাগর থেকে গরম হাওয়ার আগমন, শীতের উধাও হওয়া— এগুলো বিশ্ব উষ্ণায়ন এবং জলবায়ু বদলেরই ইঙ্গিত কি না, তা নিয়ে চর্চা শুরু হয়েছে আবহবিদদের মধ্যে। তাঁদের অনেকেই বলছেন, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক রিপোর্টে ভূপৃষ্ঠ ও সমুদ্রের উষ্ণতা বৃদ্ধি, আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনার পূর্বাভাস নিয়ে অনেক কথা বলা হয়েছে। তার কিছু কিছু লক্ষণও মিলছে। কিন্তু জলবায়ুর বদল ঘটেছে, এমন কথা এখনই বলা সম্ভব নয়। ‘‘জলবায়ু বদল হয়েছে কি না, সেই বিষয়ে নিশ্চিত হতে গেলে আরও কয়েক বছরের পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন,’’ বলছেন এক আবহবিদ।