মেঘের আস্তরণ কাটিয়ে কবে মিলবে শীতের দেখা?
পশ্চিম রাজস্থান, হরিয়ানা, চন্ডীগড়ে শৈত্যপ্রাবহ বইছে। সর্বনিম্ন তাপমাত্রা নামছে লাফিয়ে নামছে, উত্তর ভারত, গুজরাতেও। কিন্তু শীত-ভাগ্য খুলল না পশ্চিমবঙ্গের। ডিসেম্বরের গোড়া থেকে যে ভাবে কলকতার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা এই সময়ের স্বাভাবিকের থেকে ৬-৭ ডিগ্রির উপরে ঘোরাফেরা করছে, তাতে এ বছরের ডিসেম্বর মাসটি ২৫ বছরের মধ্যে উষ্ণতম হলে বিস্ময়ের কিছু থাকবে না বলে মনে করছে আলিপুর হাওয়া অফিস।
বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডব্লিউএমও) ২০১৫ সালটিকে এখনও পর্যন্ত উষ্ণতম উল্লেখ করেছে। ডিসেম্বরের বাকি ১৫ দিন তাপমাত্রা যা-ই থাকুক না এই সিদ্ধান্তের কোনও যে পরিবর্তন হবে না তা-ও জানিয়ে দিয়েছে ডব্লিউএমও। সেই নিরিখে মাঝ-ডিসেম্বরে কলকাতা সহ পূর্ব ভারতের এমন আবহাওয়ায় খুব একটা অবাক নন আবহবিদেরা। আর দু’দিন পরেই পৌষ মাস পড়বে। কলকাতায় স্থায়ী শীত ঠিক কবে পড়বে তা নিয়ে এখনই কোনও ভবিষ্যৎবাণি করতে নারাজ আলিপুর হাওয়া অফিস। ওড়িশা আর ছত্তিসগঢ়ে জোড়া নিম্নচাপ অক্ষরেখায় উত্তর ভারতের কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া আটকে রয়েছে। একের পর এক পশ্চিমী ঝঞ্ঝাও পথ খুলে দিতে পারেনি শীতের।
ঠিক কতটা বদলেছে ডিসেম্বরের তাপমাত্রা?
ডিসেম্বরের মাঝামাঝি কলকাতার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা থাকার কথা ১৪.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু গত ১৫ দিন তা মূলত ২০ থকে ২৩ ডিগ্রির মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। আবহবিদেরা এর পিছনে জলবায়ু পরিবর্তনের হাত দেখতে পাচ্ছেন। কেউ বা আবার এল নিনোর হাত দেখছেন গোটা বিষয়টায়। গত ২০-২৫ বছরের মধ্যে ২০০৮ সালে ডিসেম্বরের প্রথম ১৫ দিন কলকাতার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা তেমন নামেনি। বেশ কয়েকদিন সবর্নিম্ন তাপমাত্রা ২০ ডিগ্রির আশেপাশে ঘুরছিল। ২০১৫ কিন্তু ২০০৮ সালের রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। মৌসম ভবনের এক আবহবিজ্ঞানী কিছুটা রসিকতা করে বলেছেন, ‘‘জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব যে কী হতে পারে তার জন্য প্যারিসের বিশ্ব জলবায়ু সম্মলনের দিকে নজর রাখার দরকার নেই। ডিসেম্বরে কলকাতায় যা হচ্ছে সেটাইতো জলবায়ু পরিবর্তনেরই ফল। আমরা কোনও সম্মেলনে না গিয়েই আবহাওয়ার এই পরিবর্তন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।’’
কী ভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে গোটা বিষয়টি জুড়ছেন আবহবিদেরা?
এক আবহ বিজ্ঞানীর কথায়, ‘‘বিশ্ব উষ্ণায়ণ এবং জলবায়ুর সামগ্রিক পরিবর্তনকেই আমরা এই অস্বাভাবিকতার জন্য দায়ী করেছি। বর্ষা যে পিছিয়ে যাচ্ছে, তা যে নভেম্বর পর্যন্ত দীর্ঘায়িত হচ্ছে তা পরিষ্কার হয়েছিল ২০০৭-৮ সালেই। গত সাত বছরে আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনা আরও বেড়েছে। গত দুই বছর ধরেই দেখা যাচ্ছে বর্ষার দাপটে হেমন্তটাই পুরোটাই হারিয়ে গিয়েছে। আবার শীতটা দেরিতে পড়ায় তা দীর্ঘায়িত হচ্ছে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। আবার গ্রীষ্ম আগে থেকেই শুরু হয়ে যাওয়ায় বসন্তকালটাই মাঠে মারা যাচ্ছে। কেন্দ্রীয় সরকারের আবহবিজ্ঞানমন্ত্রকের ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল গোকুলচন্দ্র দেবনাথের মন্তব্য, ‘‘এবারের ডিসেম্বরের আবহাওয়াটা যে অস্বাভাবিক তা তো বোঝাই যাচ্ছে। তবে তার কারণটা ঠিক কী তা এখনই নিশ্চিত করে বলা যাবে না। কিছু তাৎক্ষণিক কারণ রয়েছে, দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা কিছু প্রাকৃতিক বিষয়ও রয়েছে।’’
বর্ষার মতো শীতও ধীরে ধীরে পিছিয়ে যাবে কী না উঠে গিয়েছে সেই প্রশ্নও। দিল্লির মৌসম ভবনের এক আবহবিদ জানাচ্ছেন, উত্তর ভারতের রাজ্যগুলিতে গত কয়েক বছর ধরে যে হারে প্রাক-বর্ষার বৃষ্টি হচ্ছে তা অস্বাভাবিক। একই ভাবে অস্বাভাবিক বর্ষার মতিগিতও। দেরিতে বর্ষা আসছে। আবার তা তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছে। গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গের মতো সে হেমন্তের ঘাড়ে চেপে বসছে না। তাই উত্তর ভারতে শীতটা যথাসময়ে পড়ছে। কিন্তু বর্ষার বৃষ্টিটা আগেই হয়ে যাওয়ায় সেখানকার কৃষকেরা সমস্যায় পড়ছে। জলবায়ুর পরিবর্তনই বলুন, বিশ্ব উষ্ণায়ণই বলুন কিংবা এল নিনো-ই বলুন তার প্রভাব উত্তর ভারতে এক রকম ভাবে পড়ছ, পূর্ব ভারতে আর এক রকম ভাবে পড়ছে।’’
ওড়িশা উপকূল আর ছত্তিশগঢ়ের নিম্নচাপ অক্ষরেখা-ঘূর্ণাবর্তেরা বিদায় নেবে কবে?
গোকুলবাবু বলেন, বুধবার থেকে মেঘ সরে গিয়ে তাপমাত্রা কিছুটা কমবে। কিন্তু সেই ঠাণ্ডা ভাবটা পাকাপাকি ভাবে থাকবে কী না সেই ব্যাপারে কোনও আশ্বাস দেয়নি আলিপুর হাওয়া অফিস। গোকুলবাবুর ব্যাখ্যা, ‘‘আবার কবে কোথায় নিম্নচাপ অক্ষরেখা তৈরি হয়ে গেলে মেঘ ঢুকে পড়বে। তাতে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা আবার বাড়বে।’’ আবহাওয়ার অস্থিরতায় পূর্বাভাস দিতেও যে সমস্যায় পড়ছেন আবহবিদেরা তা পরিষ্কার।
সোমবার অবশ্য শীত শীত একটা ভাব আছে সারাদিন। তবে ভোরের দিকে অস্বস্তি ছিল। আবহাওয়াবিদদের বিশ্লেষণ, আকাশে মেঘ থাকায় এদিন সকাল থেকে সূর্যই দেখা যায়নি। তাই দিনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বাড়তেই পারেনি। আর এই কারণেরই সারাদিন শীত শীত মনে হয়েছে। মেঘ কাটতে শুরু করলেই দিনের এই শীত শীত ভাবটা কাটবে। তখন রাতের তাপমাত্রা কমতে শুরু করবে।
মধ্য ডিসেম্বরের এই আবহাওয়া ভাবাচ্ছে চিকিৎসকদের। তাঁরা বলছেন, আবহাওয়ার এই পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে জীবাণু কিংবা তাদের বাহকেরা খুব তাড়াতাড়ি খাপ খাইয়ে নিতে পারে। কিন্তু মানুষ পারে না। তাই মানুষের শারীরবৃত্তীয় কাজকর্মের স্বাভাবিক ছন্দ কিছুটা হারিয়ে য়ায়। সেই সুযোগটাই নেয় জীবাণু এবং তাদের বাহকেরা। বিশেষ করে জ্বর, পেটখারাপ, সর্দি-কাশির সঙ্গে যে সব জীবাণু যুক্ত তারা অতিসক্রিয় হয়ে ওঠে এই প্রতিকূল আবহাওয়ায়। যাঁদের দেহের প্রতিরোধ ক্ষমতা স্বাভাবিক ভাবেই কম, তারাই নানা রকমের রোগে আক্রান্ত হন। এই জন্যই ডেঙ্গি-ম্যালেরিয়া বিদায় নিতেনতেও নিচ্ছে না বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকদের অনেকেই।