টানা সাত ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকেন ‘স্ট্যাচু’ শ্রীদাম, চান শিল্পীর সম্মান

একচুলও নড়েনি হারকিউলিস। উড়ে আসা ইটের টুকরোগুলো বেশ জোরেই লেগেছিল। কিন্তু স্ট্যাচুর যে নড়া বারণ! 

Advertisement

দিগন্ত মান্না

কোলাঘাট শেষ আপডেট: ১৭ ডিসেম্বর ২০১৮ ০১:৫৫
Share:

‘স্ট্যাচু’ শ্রীদাম। নিজস্ব চিত্র

একচুলও নড়েনি হারকিউলিস। উড়ে আসা ইটের টুকরোগুলো বেশ জোরেই লেগেছিল। কিন্তু স্ট্যাচুর যে নড়া বারণ!

Advertisement

তাই ‘স্ট্যাচু’ হয়েই ছিলেন শ্রীদাম মণ্ডল। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ছিনাথ বহুরূপী বাঘের সাজে নজর কাড়তে গিয়ে ভটচায্যিমশাইয়ের খড়ম পেটা খেয়েছিলেন। কোলাঘাটের শ্রীদামকে দর্শকেরা ইট মেরে দেখতে চেয়েছিলেন, হারকিউলিসের স্ট্যাচুটা আসল না নকল! ইটের ঘায়ে সে দিন আহত হয়েছিলেন শ্রীদাম।

কোলাঘাটের দেউলিয়া বাজার থেকে উত্তরে পাঁচ কিলোমিটার গেলে মানুয়া গ্রাম। পথঘাট পাকা। তবে শ্রীদামের ছোটখাটো ঘরটা তালপাতা ঘেরা, ইটের। সেখানেই স্ট্যাচু-জীবনের নানা গল্প শোনাচ্ছিলেন শ্রীদাম। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই ‘যেমন খুশি সাজো’ প্রতিযোগিতায় যেতেন। এলাকার যাত্রাপালায় তাঁর অভিনয় প্রশংসা পেত।

Advertisement

১৯৮৩ সালে মাধ্যমিক। তার পর হাওড়ার একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে আইটিআই পাশ। কিন্তু কারিগরি বিদ্যায় কাজ জোটেনি। বাধ্য হয়ে দিনমজুরি। ফাঁকে ফাঁকে ‘যেমন খুশি সাজো’ প্রতিযোগিতা আর স্ট্যাচু সাজা। মেলায় মেলায় ছুটে যান শ্রীদাম। রামকৃষ্ণ, গাঁধী, যিশু, হারকিউলিস, বিরসা মুন্ডা, ক্ষুদিরাম সাজেন। কখনও সাজ ড্রাগের নেশা সর্বনাশার থিমে।

স্ট্যাচু হওয়ার প্রস্তুতিটা সহজ নয়। রামকৃষ্ণ সাজতে তিন ঘণ্টা, ক্ষুদিরাম ও যিশু সাজতে দু’ঘণ্টা, হারকিউলিস এবং গাঁধীজি সাজতে দেড় ঘণ্টা করে সময় লাগে। এঁটেল মাটির সঙ্গে পাট মিশিয়ে শ্রীদাম নিজেই তৈরি করেন স্ট্যাচুর মাথার চুল। স্ট্যাচুর ব্যক্তিত্ব অনুযায়ী রং গায়ে মেখে এবং পোশাক পরে সেজে ওঠেন ‘শ্রীদাম বহুরূপী’। যে যা দেন তাতেই সন্তুষ্ট। বছর পাঁচেক হল ছবিটা বদলেছে। বিভিন্ন মেলা ও উৎসবে ডাক পাচ্ছেন শ্রীদাম। মিলছে পারিশ্রমিক। শ্রীদাম বলেন, ‘‘মেলায় ৬-৭ ঘণ্টা স্ট্যাচু সেজে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। পারিশ্রমিক সাতশো থেকে হাজার টাকা। তবে যাতায়াত, রং ও পোশাকেই খরচ হয় পাঁচশো টাকা।’’

শিল্পীর সরকারি পরিচয়পত্র নেই শ্রীদামের। ফলে সরকারি মেলা ও উৎসবে যোগ দিতে পারেন না। মেলা না থাকলে তাই দিনমজুরি ভরসা। স্ত্রী মানসিক ভারসাম্যহীন। মেয়ের বিয়ে হয়েছে। এক ছেলে সুখেন প্রতিবন্ধী। ছেলের প্রতিবন্ধী কার্ডও হয়নি। কোলাঘাটের বিডিও তাপসকুমার হাজরা বলেন, ‘‘শিল্পীদের ভাতার আবেদনপত্র জেলা তথ্য দফতরে পাঠাই। এ ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত ত্রুটি থাকতে পারে। যোগাযোগ করলে বিষয়টি দেখব।’’

শ্রীদামের লড়াই তাই চলছে। কম দামি রং মাখেন বলে চর্মরোগে ধরেছে। একটানা দাঁড়িয়ে থাকতে গিয়ে রাশ টানতে হয়েছে খাওয়া ও জলপানে। ফলে ভাঙছে শরীর। তবুও ৫৩ বছর বয়সে সংসারের হারকিউলিস তিনিই।

আর মনে? ফোন ধরেই শ্রীদামের গলা, ‘‘আমি স্ট্যাচু বলছি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন