মাকে ঠকিয়ে সংসার চান না, লড়াই কন্যার

আর এক মেয়ে বলছেন, ‘‘সংসার চাই, সন্তানও চাই। তবে আমার মাকে ঠকিয়ে নয়। মা জীবনে অনেক কষ্ট করেছেন।’’ তাঁর একটাই চাওয়া— যৌনপল্লির পরিবেশে পড়ে থাকা তাঁর মা, জীবনের উপান্তে এসে নিজের অধিকারটুকু যেন ফিরে পান।

Advertisement

সোমা মুখোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ জুন ২০১৯ ০৩:২৮
Share:

সিনেমায় যেমন: উত্তরফাল্গুনীতে মা-মেয়ে।

ভরা আদালতে আইনজীবী মেয়ে সওয়াল করছে স্বামীকে হত্যায় অভিযুক্তের মুক্তির জন্য। তাঁর অধিকারের জন্য। দীর্ঘ সওয়ালের শেষে আইনজীবী তরুণী বলেছিল, ‘‘মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করছি... আসামির কাঠগড়ায় যিনি আপনাদের চোখের সামনে বসে আছেন, তিনি আমার মা।’’

Advertisement

‘উত্তরফাল্গুনী’ উপন্যাসে (এবং ছবিতে) সে গল্প দেবযানী আর মেয়ে সুপর্ণার।

আর এক মেয়ে বলছেন, ‘‘সংসার চাই, সন্তানও চাই। তবে আমার মাকে ঠকিয়ে নয়। মা জীবনে অনেক কষ্ট করেছেন।’’ তাঁর একটাই চাওয়া— যৌনপল্লির পরিবেশে পড়ে থাকা তাঁর মা, জীবনের উপান্তে এসে নিজের অধিকারটুকু যেন ফিরে পান।

Advertisement

বাস্তবে এ কাহিনি বনলতা আর তাঁর মেয়ের।

৫৫ বছরের যৌনকর্মী বনলতা জীবনের অর্ধেকেরও বেশি সময় লড়াই করেছেন সন্তানদের বড় করার কাজে। আর এখন মেয়ে লড়ছেন মায়ের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে।

স্বামী অস্বীকার করেছিলেন বনলতাকে। অবসরের মুখে দাঁড়ানো কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মী সেই স্বামী এখন চান বনলতার সঙ্গে আইনি বিচ্ছেদ। তবেই স্বীকৃতি মিলবে তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী ও সন্তানদের। অভিযোগ, সেই কাজে তিনি চেয়েছিলেন আত্মজাকে ব্যবহার করতে। বছর তিরিশের মেয়েটিকে বিয়ে-সংসারের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন বাবা। বলেছিলেন, সব ব্যবস্থাই তিনি করবেন। পরিবর্তে মেয়েকে শুধু মাকে দিয়ে ডিভোর্সের কাগজে সই করিয়ে আনতে হবে। রুখে দাঁড়িয়েছেন মেয়ে। মায়ের হাত ধরে সটান গিয়েছেন রাজ্য মহিলা কমিশনের দফতরে।

কমিশনের চেয়ারপার্সন লীনা গঙ্গোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘মেয়েটির লড়াই মুগ্ধ করেছে। যে জীবন ও কাটাচ্ছে, এক মুহূর্তে সেটা থেকে মুক্তি পেতে পারত। কিন্তু ওর জীবনবোধই আলাদা। ও আপস করবে না। মাকে অধিকার পাইয়েই ছাড়বে। সেই কাজে আমাদের সাহায্য ওর দরকার। পাশে আছি। ওর বাবা যে সংস্থায় কাজ করেন, সেই সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। প্রয়োজনে আইনি পদক্ষেপও করা হবে।’’

এই গল্পের শুরু ৩৫ বছর আগে। আলমবাজারের যৌনপল্লিতে নিয়মিত যাতায়াত ছিল স্থানীয় বাসিন্দা, কেন্দ্রীয় সরকারি এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চতুর্থ শ্রেণির কর্মীর। সেই সূত্রেই বনলতার সঙ্গে পরিচয়, সম্পর্ক। মন্দিরে গিয়ে বিয়ে করেন তাঁরা। তিনটি সন্তানও হয়। এর পরে তাঁকে অস্বীকার করে দ্বিতীয় বার বিয়ে করেন স্বামী। যৌনকর্মীর পেশা সম্বল করেই সন্তানদের বড় করার কাজ শুরু করেন বনলতা। এর বছর কয়েকের মধ্যে তাঁর বড় ছেলে খুন হয়। ছোট ছেলে এবং মেয়েকে একটি ভাড়া বাড়িতে রাখার ব্যবস্থা করেন তিনি। ছোট ছেলে মানসিক ভাবে অসুস্থ। তার চিকিৎসায় প্রতি মাসে প্রচুর খরচ হয়। বনলতা বলেন, ‘‘ছেলেটাকে বাঁচাতে হবে তো। তাই কাজ ছাড়তে পারিনি।’’ তাই খুঁড়িয়ে হাঁটেন, একটানা কথা বলতে গেলে হাঁফিয়ে ওঠেন, তবু কাজ ছাড়তে পারেন না বনলতা। এখনও থাকেন যৌনপল্লিতেই। শুধু কাজের তাগিদে নয়। যৌনপল্লির পরিবেশ থেকে সন্তানদের দূরে রাখার চ্যালেঞ্জে জিতে যাওয়া মা বলেন, ‘‘জীবনের সব চেয়ে কঠিন সময়ে এই এলাকা আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। তাই এখান থেকে যাব না। তা ছাড়া মেয়ের জীবনে সরাসরি আমার ছায়া পড়তে দিতে চাই না। এক সঙ্গে থাকলে কোনও ভাবে লোকে জেনে যাবে আমার পরিচয়। তখন মেয়েটা আর সুস্থ ভাবে বাঁচতে পারবে না।’’

আপাতত এক বাড়িতে আয়ার কাজে মাসে চার হাজার টাকা উপার্জন করেন বনলতার মেয়ে।

মা টাকা পাঠালেও ভাইয়ের জন্য মাসে হাজার টাকার ওষুধ, বাড়িভাড়া। চলে কী ভাবে? মেয়ের উত্তর, ‘‘বেঁচে থাকার জন্য নুন-ভাত হলেই তো চলে যায়।’’

কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থার ওই কর্মী বনলতাকে পরে অস্বীকার করলেও সংস্থায় স্ত্রী হিসেবে থেকে গিয়েছে তাঁর নাম। তাই বাড়ি থেকে শুরু করে অবসরের পরে প্রাপ্য টাকা, সবেতে বনলতারই অধিকার! এই পরিস্থিতিতে মেয়ের সাহায্য চেয়েছিলেন বাবা। মেয়ে কমিশনে জানিয়েছেন, বাবা বলেছিলেন, নগদ কিছু টাকা এবং বিয়ের ব্যবস্থা সবটাই করবেন। পাত্র ঠিকও হয়ে গিয়েছিল। শর্ত একটাই। মাকে দিয়ে ডিভোর্সের কাগজে সই করিয়ে আনতে হবে। বাবার মুখের ওপরে না বলে মায়ের হাত ধরে সে দিনই কমিশনে পৌঁছেছিলেন মেয়ে। কমিশনের দফতরে বসে বললেন, ‘‘সংসারের খুব শখ আমার। খুব চাই, নিজের সন্তান হোক। কিন্তু মাকে বলি দিয়ে তা চাই না। মা নিজের জীবনটা তিল তিল করে শেষ করল। মায়ের অধিকারের বিনিময়ে নিজের সুখ কিনতে পারব না। ’’

চোখে আগুন ঝরিয়ে মেয়ে যখন কথাগুলো বলেন, অঝোরে জল পড়ে বনলতার চোখ থেকে। অস্ফুটে বলতে থাকেন, ‘‘এতটাও কি পাওনা ছিল আমার? সবাই তো ঘেন্নাই করে এসেছে বরাবর...।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন