যুদ্ধ: পা দিয়ে মোবাইল চালাচ্ছেন রাহুল। পাশে মা। —নিজস্ব চিত্র।
কোনও দিন স্কুলের চৌকাঠ পেরোননি যুবক। শুনে শুনেই মুখে হিসেব কষতে জানেন। বড় যোগ-বিয়োগ ক্যালকুলেটরে হিসেব কষেন। শৈশব থেকেই তাঁর দু’টি হাতের উপরে নিয়ন্ত্রণ ছিল না। দিনে দিনে তা সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। তাই বছর ছয়েক আগে পর্যন্ত দুটো পা দিয়েই হাতের কাজ করতেন পুরুলিয়ার রঘুনাথপুরের বাসিন্দা, বছর একুশের যুবক রাহুল মুখোপাধ্যায়। পা দিয়ে থালা টেনে খাবার বেড়ে নেওয়ার মতো কাজও করতে পারতেন তিনি। এমনকি পা দিয়ে মোবাইল চালানোতেও স্বচ্ছন্দ ছিলেন ওই যুবক। বছর কয়েক চিকিৎসা বন্ধ থাকায় ২০১৩ সালের পর থেকে ওই পা দু’টিও নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। ঘাড় থেকে পা অনিয়ন্ত্রিত থাকায় চেয়ারে কেউ ধরেও বসিয়ে রাখতে পারতেন না তাঁকে।
জন্ম থেকেই মিক্সড সেরিব্রাল পলসিতে আক্রান্ত ওই যুবক। অতি দরিদ্র পরিবারে বেড়ে ওঠা রাহুলের চিকিৎসায় সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়েছিলেন তাঁর বাবা-মা। বিভ্রান্ত পরিবার কখনও হোমিওপ্যাথি, কখনও আয়ুর্বেদ চিকিৎসায় ফল মেলার আশায় ছুটে গিয়েছেন। এ সবের জেরে বারবার বাধা পেয়েছে মূল চিকিৎসা। এর ফলে পায়ের উপরেও নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিলেন রাহুল।
স্বপন এবং রিনা মুখোপাধ্যায়ের বড় সন্তান রাহুল। ছোট ছেলে নবম শ্রেণির ছাত্র। রঘুনাথপুরে একটি ওষুধের দোকানের কর্মচারী স্বপনবাবু। ভাঙাচোরা দু’কামরার ঘরে অসুস্থ ছেলেকে নিয়ে হার না মানা লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা। আপাতত মা এবং ছেলের ঠিকানা এসএসকেএম হাসপাতালের ফিজিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন বিভাগ। গত ১৯ মার্চ থেকে সেখানেই ভর্তি রাহুল।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
রিনাদেবী বলেন, “জন্মের সময়ে ছেলের ওজন খুব কম ছিল। যত্ন নেওয়ায় সাত-আট মাস বয়সে ওজন বাড়লেও ঘাড় হেলে থাকত। তখন বুঝতে পারতাম না কেন এমন হচ্ছে। ওর বয়স যখন বছরখানেক, তখন থেকেই ডাক্তার দেখাচ্ছি। জানতে পেরেছিলাম, নার্ভের সমস্যা। কিন্তু কী, সেটা স্পষ্ট করে কেউ বলেননি। পরে ভেলোরে নিয়ে গিয়েছিলাম।” ধার-দেনার টাকাও এক সময়ে শেষ হয়ে যায়। তা সত্ত্বেও ছেলেকে নিয়ে এ দিক-ও দিক ছুটে গিয়েছেন দম্পতি। ইচ্ছে থাকলেও ছেলেকে স্কুলে পাঠাতে পারেননি তাঁরা। তবে আজও নিয়ম করে ছেলেকে নিয়ে পড়তে বসান রিনাদেবী। ইংরেজি শব্দ গঠনে বেশি উৎসাহী রাহুল। ভাই পড়তে বসলে পাশে বসে থাকেন তিনি। ভাই কিছু ভুলে গেলে মনেও করিয়ে দেন তিনি।
তাঁর প্রিয় খাবার পাঁঠার মাংস। তবে ছেলের পোস্ত প্রেমের কথা জেনে গিয়েছেন হাসপাতালের ক্যান্টিন কর্মীরাও। এখনও পর্যন্ত আইপিএলের একটি ম্যাচও দেখতে না পারায় মন খারাপ রাহুলের। কলকাতার সমর্থক দীনেশ কার্তিকের ভক্ত রাহুলের চোখ আটকে ক্যালেন্ডারে। ‘‘এখন তো পা কিছুটা ভাল হয়েছে। ৩০ মে ক্রিকেট বিশ্বকাপ শুরুর আগে বাড়ি ফিরতেই হবে। খেলা মিস করা যাবে না।’’— জড়ানো কথায় বলে উঠলেন রাহুল।
এসএসকেএম হাসপাতালে রাহুলের চিকিৎসক রাজেশ প্রামাণিক বলেন, “সেরিব্রাল পলসির একটি ধরন ডিস্টোনিয়ায় আক্রান্ত ওই যুবক। সেই সঙ্গে স্প্যাস্টিকও। বেশ জটিল অবস্থায় ওঁকে নিয়ে আসা হয়েছে। এই মুহূর্তে ওঁর বিভিন্ন শারীরচর্চা, অকুপেশনাল থেরাপি প্রভৃতি চলছে। সঙ্গে ওষুধও চলছে। আগের তুলনায় পায়ের উপরে খানিকটা নিয়ন্ত্রণ আসছে। পেশী কিছুটা স্থিতিশীল করতে ওঁকে ইঞ্জেকশন দেওয়া হবে।”
চিকিৎসক অপূর্ব ঘোষের মতে, “এ ক্ষেত্রে সঠিক শারীরচর্চা সব থেকে বড় কথা। চিকিৎসা বন্ধ করায় যে ক্ষতি হয়েছে, তা হয়তো পূরণ হবে না। কিন্তু কিছু তো অবশ্যই উন্নতি হবে।”